আকারে ছোট হলেও টেংরার অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে বেশ। মাছটি নিয়ে আজকের আয়োজন
মাছের নাম টেংরা। নামটি অদ্ভুত, কিন্তু খেতে সুস্বাদু। অন্যান্য মাছের তুলনায় টেংরায় কাঁটা কম হওয়ায় অনেকের কাছে বেশ প্রিয়। একসময় খালবিলসহ বিভিন্ন জলাশয়ে এ মাছ দেখা যেত। খালবিল কমে যাওয়া ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে এর প্রজনন বৃদ্ধি না পেয়ে বরং হ্রাস পেয়েছে। অথচ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এ মাছকে বাঁচিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য টেংরার কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে চাষ করে তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব। টেংরা চাষের জন্য কিছু কৌশল ও পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি
টেংরা চাষযোগ্য পুকুরের আয়তন হতে হবে অন্তত আট থেকে ১০ শতাংশে। এর গভীরতা হবে এক মিটার। মাছ ছাড়ার আগে পুকুরটি শুকিয়ে নিতে হবে। শুকনো পুকুরের প্রতি শতাংশে এক কেজি হারে চুন দিতে হবে। চুন দেওয়ার পাঁচ থেকে ছয় দিন পর ইউরিয়া, টিএসপি ও গোবর সার ব্যবহার করতে হবে। এরপর সূক্ষ্ম নাইলন জালের মধ্য দিয়ে পানি প্রবেশ করাতে হবে। পানি দেওয়ার চার থেকে পাঁচ দিন পর পোনা ছেড়ে দেওয়া যাবে। পুকুরের চারপাশ নেট দিয়ে ঘিরে দিতে হবে, যাতে বর্ষার পানিতে মাছ ছড়িয়ে না যায়, কিংবা অন্য কোনো মাছ চাষকৃত পুকুরে ঢুকতে না পারে।
টেংরার প্রজননকাল
টেংরার প্রজননকাল এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত। প্রজনন মৌসুমের আগে সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত আট থেকে ১০ গ্রাম ওজনের টেংরা সংগ্রহ করে কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্রুড তৈরি করা হয়। প্রস্তুত করা পুকুরে ছেড়ে দেওয়ার আগে অবশ্যই এসব কাজ সেরে নিতে হবে। প্রজননের জন্য পুকুরের পাশে সিস্টার্ন নেটের হাপা তৈরি করে নিতে হবে।
কৃত্রিম প্রজননের কৌশল
কৃত্রিম প্রজননের আগে কোনো খালবিল বা পুকুর থেকে পরিপক্ব পুরুষ ও স্ত্রী মাছ তুলে সিমেন্টের তৈরি সিস্টার্নে অথবা ফাইবার গ্লাস ট্যাঙ্কে প্রায় এক দিন রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ সময় মাছগুলোকে কোনো খাবার দেওয়া যাবে না। সিস্টার্নে অক্সিজেন নিশ্চিত করতে কৃত্রিম ঝরনা ব্যবহার করতে হবে। টেংরার স্ত্রী ও পুরুষ উভয়কে পিটুইটারি গ্ল্যান্ড (পিজি) অথবা ওভাটাইড বা ওভাপ্রিম হরমোন পাখনার নিচের অংশে ইনজেক্ট করতে হবে। এ ইনজেকশন দেওয়ার পর হাপায় ১:২ অনুপাতে স্ত্রী ও পুরুষ রাখতে হবে। প্রতিটি হাপায় দুই থেকে তিনটি করে স্ত্রী মাছ রাখা যেতে পারে। প্রজননকালে আশপাশের পরিবেশ কোলাহলমুক্ত রাখতে হবে। মাছে হরমোনের ইনজেকশন সন্ধ্যায় দেওয়াই শ্রেয়। হরমোন প্রয়োগ করার আট থেকে ৯ ঘণ্টা পর হাপাতেই স্ত্রী টেংরা ডিম ছাড়ে। ডিম আঠাল অবস্থায় হাপার চারপাশে লেগে যায়। ডিম দেওয়ার পর হাপা থেকে ব্রুডগুলো সরিয়ে নিতে হবে। ডিম ছাড়ার ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা পর ডিম ফুটে রেণু বের হয়। রেণুর ডিম্বথলি নিঃশেষিত হওয়ার পর রেণুকে খাবার দিতে হবে। হাপাতে রেণু পোনাকে এভাবে সপ্তাহব্যাপী রাখার পর চাষযোগ্য পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
টেংরা চাষে সম্ভাবনা
বাংলাদেশের মৎস্য খাত সম্ভাবনাময়, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অন্যান্য মাছের পাশাপাশি টেংরা উৎপাদন করেও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করা সম্ভব।
টেংরার কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে মৎস্যচাষিদের জন্য নতুন দিগন্তের সূচনা করা যেতে পারে। এ খাতে নতুন কর্মসংস্থানের উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া প্রজনন ও উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আবদ্ধ জলাশয়ে এ মাছের বাণিজ্যিক চাষের দ্বার উম্মোচন করা সম্ভব। চাষাবাদ বৃদ্ধির ফলে এ মাছের যে ঘাটতি রয়েছে তা দূর করা যাবে।
টেংরা খেতে সুস্বাদু। তাই বাজারে এর মূল্য অন্য মাছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি। এ মাছ চাষ করতে পারলে তুলনামূলকভাবে বেশি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। ফলে হ্যাচারি ও পুকুর মালিকদের আয় বৃদ্ধিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখছে। শিক্ষিত বেকার যুবকরা কৃত্রিম পদ্ধতিতে টেংরা চাষ করে বেকারত্ব ঘোচাতে পারে। কৃত্রিম পদ্ধতিতে এ মাছ চাষে লোকসানের সম্ভাবনা নেই বললে চলে।
খরাপ্রবণ অঞ্চলে পুকুরে টেংরা চাষ করে
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী যদি টেংরার সঠিক পরিচর্যা করা যায়, তাহলে একেকটি এলাকা থেকে যে পরিমাণ মাছের জোগান আসবে তাতে এ দেশীয় মাছের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ হতে পারে। এছাড়া সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে টেংরা চাষ করে যেমন কর্মসংস্থানের অভাব দূর করা যাবে, তেমনি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে একে একটি লাভজনক খাতে পরিণত করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিভিন্ন প্রজাতি ও বিবরণ
টেংরা
সাধারণ টেংরার পিঠের দিক পিঙ্গল রঙের হয়। পেটের দিক সাধারণত সাদাটে হয়ে থাকে। শরীরের পাশে ও নিচে লম্বালম্বি দুটি ব্যান্ড রয়েছে। এগুলো হালকা রঙের। এটি দৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ ১৪ সেন্টিমিটার হয়
গোলসা টেংরা
পার্শ্বরেখার ওপরে গাঢ় রঙের দুটি চ্যাপ্টা ও নিচে দুটি সরু ব্যান্ড রয়েছে এ প্রজাতির। ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে গোলসা টেংরা
গুলি টেংরা
গুলি টেংরার পিঠের দিক পিঙ্গল বর্ণের। পেটের দিক ফ্যাকাশে সাদা। এর চোয়ালের স্পর্শী আংশিক কালো। দৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়
কাবাসি টেংরা
এ ধরনের টেংরার পিঠের কাঁটার গোড়ায় কালো দাগ থাকে। এটি লম্বায় ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়
বজুরি টেংরা
বজুরি টেংরার রঙ পিঙ্গল। কানের পেছনে কালো দাগ রয়েছে। এর শরীরে লম্বালম্বি কয়েকটি দাগ রয়েছে। এটি দৈর্ঘ্যে ছয় সেমি পর্যন্ত হয়।
পরিচর্যা ও খাবার
# প্রজনন মৌসুমে ব্রুড মাছের পরিচর্যার ক্ষেত্রে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। পোনা উৎপাদনের জন্য সুস্থ-সবল ও অক্ষত মাছ বেছে নিতে হবে
# হাপার পানি ও চাষ করা পুকুরের পানির রাসায়নিক ও ভৌত গুণাগুণ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে
# পোনা উৎপাদনের সময় ব্যবহার করা সব যন্ত্রপাতি ও উপকরণ যথাসম্ভব জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে
# মাছের স্বাস্থ্য ও পরিপক্বতা দেখার জন্য অন্তত ১৫ দিন পর জাল টেনে পর্যবেক্ষণ করতে হবে
# নিয়মিত পানির গুণাগুণ যেমন তাপমাত্রা, পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া ও ক্ষারত্বের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে
# হাপায় রেণু পোনাকে খাদ্য দেওয়ার চার থেকে পাঁচ দিন পর পুকুরে ছাড়তে হবে। কেননা এ সময় এদের মধ্যে একে অপরকে খেয়ে ফেলার প্রবণতা থাকে
# পুরোনো পুকুর হলে সম্পূর্ণ পানি সেচের মাধ্যমে ফেলে দিতে হবে। পরে রোদে শুকিয়ে মিশ্রিত সার দিয়ে নতুন করে পানি দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, চাষ করা পুকুরে যেন ক্ষতিকর কোনো প্রাণী না থাকে। এতে পোনার ক্ষতি হতে পারে
# ডিম ফুটে রেণু বের হওয়ার পর অন্তত দুই দিন রেণু পোনাকে কোনো খাবার দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এ সময় এরা শরীর ডিম্বথলি থেকে পুষ্টি পেয়ে থাকে। দুই দিন পর খাবার দিতে হয়, তখন পোনার খাদ্য হিসেবে মুরগির সেদ্ধ ডিমের কুসুম দেওয়া যেতে পারে। সেদ্ধ ডিমের কুসুম পানিতে গুলিয়ে ঘন ছাঁকনির মাধ্যমে অল্প অল্প করে প্রয়োগ করতে হবে। ডিমের কুসুম খাওয়ার পর রেণুপোনার পেট সাদা দেখায়। সব পোনা খাবার পেলে কুসুম দেওয়া বন্ধ করতে হবে। কারণ অতিরিক্ত কুসুম দিলে পানি নষ্ট হয়ে পোনার ক্ষতি করতে পারে। এভাবে সেদ্ধ ডিমের কুসুমের দ্রবণ ছয় ঘণ্টা পরপর চারবার দিতে হবে
# পরিপক্ব করে তোলার জন্য মাছকে সুষম খাবার দিতে হবে। সেক্ষেত্রে চাউলের কুড়া ও সরিষার খৈল মাছের জন্য খুবই উপকারী। এ খাদ্য প্রতিদিন সকাল ও বিকালে আধা ভেজা করে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে
স প্রাকৃতিক খাবারের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য জৈব, ইউরিয়া ও টিএসপি সার পানিতে গুলিয়ে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
ছোট হলেও পুষ্টিতে সমৃদ্ধ
বলা হয় আকারে ছোট হলেও পুষ্টিতে ছোট নয় ছোট মাছ। পুষ্টিগুণ বিবেচনায় বড়, মাঝারি কিংবা ছোট মাছে কোনো তফাত নেই। অর্থাৎ আকারের ওপর মাছের পুষ্টিগুণ নির্ভর করে না। টেংরার বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।
# টেংরায় যথেষ্ট পরিমাণে আমিষ রয়েছে।
# এ মাছের আমিষ মানবদেহের বৃদ্ধিসাধন ও ক্ষয়পূরণের কাজে উপকারী। ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি দৈহিক গঠনে সহায়ক আমিষ।
# প্রতি ১০০ গ্রাম টেংরায় রয়েছে ১৯ দশমিক দুই গ্রাম আমিষ, ছয় দশমিক চার গ্রাম চর্বি, ১৪৪ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ২৭০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১৭০ মিলিগ্রাম ফসফরাস ও দুই মিলিগ্রাম লৌহ।
# আমাদের শরীরের আমিষের ঘাটতি পূরণ করে ও দৈহিক গঠনে সহযোগিতা করে।
# টেংরার প্রাণীজ চর্বি দেহের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায়।
# এর ক্যালশিয়াম হাড় ও দাঁতের গঠনে বিশেষ কার্যকর।
# কফ ও পিত্ত কমায়।
# শরীরে বল বাড়ায়।
# মাছটিতে রয়েছে উপকারী কোলিন ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। এ এসিড হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে।