সোনালী মুরগী পালন দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে আমাদের দেশে। এর অন্যতম কারণ সোনালি মুরগির রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং এর বাজার চাহিদা। নতুন করে যারা খামার করতে চান, তাদের অনেকেই প্রথমে সোনালি মুরগি দিয়ে খামার শুরু করার কথা চিন্তা করেন। আবার এমন অনেকে আছেন যারা ব্রয়লার বা লেয়ার খামার করে লছ করে নতুনভাবে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
আমাদের এই লেখাটি মূলত নতুন খামারিদের উদ্দেশ্যে। তবে অভিজ্ঞ খামারী হলেও আপনি লেখাটি পড়ে উপকৃত হতে পারেন।
কেন সোনালি মুরগী পালন করবেন
সোনালি মুরগির জাত বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী। অন্যদিকে এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই ভালো। অন্যান্য হাইব্রিড জাতের তুলনায় সোনালি মুরগির রোগ-বালাই বেশ কম। সাধারন আবহাওয়া পরিবর্তনের তেমন প্রভাব এর উপর পড়েনা।
নিয়মিত টীকা প্রদান ও জৈব নিরাপত্তা মেনে চললে খামারে রোগ-বালাই আনুপাতিক হারে কম দেখা যায়।
অপরদিকে ব্রয়লার মুরগির মাংসের প্রতি অনেকের অনীহা থাকলেও সোনালি মুরগির মাংসের চাহিদা ব্যাপক। বাজার দর বেশ ভালো থাকায় এর বানিজ্যিক গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সোনালী মুরগির বাচ্চা নির্বাচন
সোনালি একটি স্বতন্ত্র মুরগির জাত হলেও বর্তমানে এর কিছু ভ্যারিয়েশন বাজারে বিদ্যমান রয়েছে। সোনালি, সোনালি ক্লাসিক ও হাইব্রিড সোনালি নামে বাচ্চার বাজারজাত করন হয়ে থাকে।
সত্যিকার সোনালি অর্থাৎ আর-আই-আর ও ফাউমি মুরগির সংকরায়নে সোনালী মুরগির জাত উদ্ভাবিত হলেও ইনব্রিডিং ও বিভিন্ন কারনে এর মূল জাতের বৈশিষ্ট্য লোপ পেয়েছে। ফলে জাত উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন হ্যাচারি অন্যান্য ভারি জাতের মুরগির সাথে ক্রসব্রিড করে সোনালির জাত উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এজন্যই বাজারে সোনালী মুরগীর বিভিন্ন ভ্যারিয়ান্ট বিদ্যমান।
এক্ষেত্রে নিচের টেবিল থেকে আপনি আপনার সোনালী মুরগির জাত পছন্দ করতে পারেন।
বাচ্চার নাম | সংকরায়ন | ৬০ দিনে ওজন | ডিমের হার (%) | বাজার দর |
সাধারণ সোনালি | ইনব্রিড- সোনালি থেকে সোনালী | ৭০০-৮০০ গ্রাম | ৬৫-৭০% | খুব বেশি (প্রায় দেশি মুরগির কাছাকাছি) |
ক্লাসিক সোনালী | আর-আই-আর মোরগ X ফাউমি মুরগি | ৮৫০-৯৫০ গ্রাম | ৭০-৭৫% | সাধারণ |
ক্লাসিক সোনালী | আর-আই-আর মুরগি X ফাউমি মোরগ | ৮০০-৯০০ গ্রাম | ৭২-৮০% | বেশি |
সোনালি হাইব্রিড | সোনালি মুরগি X ক্রয়লার মোরগ ১০% | ৯৫০-১১০০ গ্রাম | ৫৫-৬৫% | কম |
সোনালী মুরগীর বৈশিষ্ট ও এর জাত সম্পর্কে জানতে আমাদের নিচের লেখাটি পড়তে পারেন।
“সোনালি মুরগি সম্পর্কে দরকারী তথ্য“
যেভাবে সোনালী মুরগির ঘর প্রস্তুত করবেন
সোনালী মুরগী পালনে ঘর হবে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর লম্বা। প্রস্থ সাধারনত ২০ থেকে ২৫ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ১৫০ ফুট বা চাহিদা অনুযায়ী করা যেতে পারে।
মেঝে হবে মাটি থেকে কমপক্ষে এক ফুট উচুতে। এবং চারপাশ ভালোভাবে নেট দিয়ে ঘেরা দিতে হবে। খেয়াল রাখা প্রয়োজন, যেন বাহির হতে কোন কিছু শেডে প্রবেশ করতে না পারে।
মার্কেট বা রেডি সোনালি (৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি) পালনে প্রতিটি মুরগির জন্য ০.৮৫ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। অর্থাৎ, ১০০০ সোনালি মুরগির জন্য ৮৫০ বর্গফুট জায়গা দিতে হবে।
ডিমের জন্য পালন করলে প্রতিটি মুরগির জন্য ১.৫ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন।
কম জায়গায় পালন করলে মুরগির বেশ কিছু রোগ দেখা দিতে পারে। যেমন, গাম্বুরো, রক্ত আমাশয় ইত্যাদি। আবার বেশি যায়গা দিলে মুরগির খাদ্য অপচয় ও গ্রোথ কম হতে পারে।
লিটার ব্যবস্থাপনা
সোনালি মুরগির লিটার হিসেবে ধানের তুষ ব্যাবহার করা শ্রেয়। তবে কাঠের গুড়াও ব্যবাহার করা যায়। লিটার হিসেবে বালির উপরও সোনালি পালন করা যেতে পারে। খেয়াল রাখা প্রয়োজন যেন ঠান্ডা না লাগে।
লিটার এক থেকে দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত পুরু করে দিতে হবে। প্রয়োজন অনুসারে লিটার নাড়িয়ে দিতে হবে। গ্যাস জমতে দেয়া যাবেনা।
ব্রুডার ঘর ব্যবস্থাপনা
বাচ্চা আসার তিন ঘন্টা থেকে আসার পর প্রথম ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত করনীয় ব্রুডারের সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন লিটার পেপার, চিকগার্ড, পানি, হোভার, খাবারের পাত্র সব তিন ঘন্টা আগেই বসিয়ে নিতে হবে যথাযথ জায়গায়।
হোভারের লাইট দুই-তিন ঘন্টা আগেই জ্বালিয়ে রাখতে হবে এবং একঘন্টা পর থার্মোমিটারের রিডিং পরীক্ষা করতে হবে।
বাচ্চা আসার ১০ মিনিট আগেই পানির পাত্র এবং খাবার পাত্র যথাযথ জায়গায় বসিয়ে দিতে হবে।
যদি দুর্বল বাচ্চা থাকে তবে এদের পৃথক করে গ্লুকোজের পানি ফোটায় ফোটায় খাইয়ে দিতে হবে।
সবল থাকলে প্রথম দুই ঘন্টা শুধুমাত্র জীবানুমুক্ত সাদা পানি দিতে হবে। দুর্বল থাকলে গ্লুকোজের পানি দিতে হবে।
ব্রুডারে ছাড়ার ১০ মিনিট পর খাবার দিতে হবে। এক্ষেত্র শুধুমাত্র প্রথমবার পেপারে ছিটিয়ে দিয়ে পরে অবশ্যই ট্রেতে খাবার দিতে হবে।
বাচ্চার অবস্থা ৩ ঘন্টা পরপর পর্যবেক্ষণ করতে হবে দেখতে হবে তাপ বেশী হচ্ছে কিনা। কোন সমস্যা থাকলে সমাধান করতে হবে এবং বাচ্চা মৃত থাকলে সরিয়ে ফেলতে হবে। খাবার পানি শেষ হলে খাবার পানি দিতে হবে। পেপার ভিজে গেলে পাল্টে দিতে হবে। ২৪ ঘন্টা পর পেপার সম্পূর্ন ভাবে সরিয়ে ফেলতে হবে।
পুলেট সোনালী ব্যবস্থাপনা
রেডি মুরগি পালনে পুলেট ব্যাবস্থাপনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পুলেটের ইউনিফরমিটি ঠিক না থাকলে সঠিক বাজার মূল্য পাওয়া যায় না। আর বাড়ন্ত সোনালির ইউনিফরমিটি ধরে রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং। নিয়মিত ভাবে গ্রেডিং করে আলাদাভাবে খাদ্য প্রদান করলে ভাল বাজার মূল্য পাওয়া যায়।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
ব্রয়লার মুরগির মতো সোনালি খাদ্য চাহিদা নেই। যত খাবে তত দ্রুত বাড়বে ধারনাটি সোনালী মুরগী পালন এর বেলায় প্রযেয্য নয়। সোনালির গ্রোথ রেট কম। বিধায় এর খাদ্যে প্রোটিন এনার্জি মান ব্রয়লারের তুলনায় কম থাকে।
আরো জানতে পড়ুনঃ সোনালি মুরগির খাবার তৈরি
পুলেট সোনালি মুরগিকে তিন বেলা খাবার দেয়া যেতে পারে। সকালে মোট খাবারের ৪০% দুপুরে ২০% ও বিকালে ৪০% হারে খাবার দেয়া যেতে পারে।
খাবার পাত্র দিতে হবে বুক বরাবর এবং লক্ষ রাখতে হবে খাবার যেন অপচয় না হয়।
পানি ব্যবস্থাপনা
মুরগিকে কমপক্ষে তিনবার পরিস্কার পানি দিতে হবে। শীতকালে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে যেন, ঠান্ডা পানি পাত্রে জমে না থাকে। যদি থেকে যায়, পাত্রের পানি ফেলে দিয়ে পুনরায় নতুন পানি দিতে হবে।
পানির পাত্র দিতে হবে চোখ বরাবর। তাহলে পাত্রে ময়লা কম পড়বে। ফলে পানি বাহিত রোগ কম হবে। প্রতিদিন পানির পাত্র পরিস্কার করতে হবে।
মনে রাখা প্রয়োজন, মুরগির অধিকাংশ রোগ পানির মাধ্যমে আসে।
সোনালি মুরগির রোগ সমূহ
সোনালি মুরগির সাধারন রোগ সমূহের মধ্যে রয়েছে, রানিক্ষেত, গাম্বুরো, কক্সিডিওসিস, করাইজা, কলেরা সহ বেশ কিছু ঠান্ডা জনিত রোগ। তবে নিয়মিত টীকা বা ভ্যাকসিন প্রদান করলে এবং খামারে সঠিক জৈব নিরাপত্তা মেনে চললে অধিকাংশ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়।
সোনালী মুরগীর রোগ ও এর প্রতিকার নিয়ে আমাদের একটি লেখা রয়েছে।
সোনালি মুরগির ভ্যাকসিন শিডিউল
নিচে সোনালি মুরগি পালনের একটি ভ্যাকসিন শিডিউল দেয়া হলো।
বয়স (দিন) | রোগের নাম | ভ্যাক্সিনের নাম | প্রয়োগের স্থান |
৩-৫ | রানীক্ষেত ও ব্রংকাইটিস | আইবি+এনডি | এক চোখে এক ফোঁটা |
১০-১২ | গামবোরো | আই বি ডি | মুখে এক ফোঁটা |
১৮-২২ | গামবোরো | আই বি ডি | খাবার পানিতে |
২৪-২৬ | রানীক্ষেত | এন ডি | এক চোখে এক ফোঁটা |
৪৪-৪৮ | রানীক্ষেত* (প্রাদুর্ভাব বেশি থাকলে) | এন ডি | খাবার পানিতে |
যদি ডিম বা প্যারেন্টস স্টক তৈরীর উদ্দ্যশে সোনালী মুরগী পালন করা হয় তবে লেয়ার মুরগির ভ্যাকসিন শিডিউল অনুসরন করতে হবে।
সোনালী মুরগী পালনে ব্যাবসায়ীক হিসাব
এককালীন খরচ
খরচের খাত | মূল্য টাকায় (আনূমানিক) |
ঘর তৈরি (টিনের সেমি পাকা) | ১,১০,০০০৳ |
খাদ্য ও পানির পাত্র | ৬,০০০৳ |
ব্রুডার সরঞ্জামদি ও পর্দা | ২,০০০৳ |
মোট | ১,১৮,০০০৳ |
১০০০ সোনালি মুরগি পালনে খরচের হিসাব
খরচের খাত | মূল্য টাকায় (আনূমানিক) |
একদিনের বাচ্চা (১০০০ পিছ * ২২৳) | ২২,০০০৳ |
মোট খাদ্য (৫০ কেজি *৪০ বস্তা * ৪০৳) | ৮০,০০০৳ |
মেডিসিন | ৫,০০০-৭,০০০৳ |
ভ্যাকসিন | ১৬০০৳ |
লিটার | ৩২০০৳ |
বৈদ্যুতিক বিল | ১২০০-১৫০০৳ |
কর্মচারী / শ্রমিক | ৮,০০০-১০,০০০৳ |
মোট | ১,২১,০০০ – ১,২৬,৫০০ |
বিঃদ্রঃ এখানে রেডি সোনালি অর্থাৎ ৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের সোনালী মুরগী পালন এর হিসেব দেখানো হয়েছে। উল্লেখ্য বাচ্চা, খাদ্য সহ অন্যান্য খরচের খাত সমূহের দাম পরিবর্তনশীল। এখানে শুধুমাত্র ধারনা দেয়া হয়েছে।
সোনালি মুরগি পালনে আয়ের পরিমান (সম্ভাব্য)
১ হাজার সোনালি ৯০০ কেজি (±৫০) * ১৮০৳ = ১,৬২,০০০৳ (± ১০,০০০৳)
অর্থাৎ লাভের পরিমান প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। মনে রাখা প্রয়োজন, এই লাভের পরিমান বাজার দরের পরিবর্তনে কমবেশি হতে পারে।
লাভজনক খামার ব্যাবস্থাপনা
আপনার খামারকে লাভজনক প্রথিষ্ঠানে পরিনত করতে চাইলে অনেকগুলি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরী। যেমন, মৃত্যুহার শুন্যের কোটায় রাখা, সঠিক ওজন নিয়ে আসা, মার্কেট বুঝে বাচ্চা উঠানো ইত্যাদি রয়েছে।
খামারকে রোগমুক্ত রাখার জন্য বায়োসিকিউরিটি মান্য করা জরুরি। সঠিক সময়ে ভ্যাকসিন দিতে হবে। ভালোমানের খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
খামার ও তার আশেপাশের পরিবেশ সর্বদা পরিস্কার ও জীবানু মুক্ত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করা লাভজনক খামার ব্যবস্থাপনার অন্যতম শর্ত।