আমাদের দেশে জনসাধারণের জীবনযাপনের সঙ্গে পারিপার্শ্বিক পটভূমিতে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটি চালু হয়েছে সঙ্গত কারণে। কিন্তু প্রযুক্তির এই যুগে এসেও কালের বিবর্তনে অনেক প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নতুন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ স্থান দখল করছে। তবে সামগ্রিকভাবে মাছ ছাষ, উৎপাদন, মাছ খাওয়া, মাছ রফতানিও বাড়ছে দিন দিন। শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে মাছ চাষের প্রতি ক্রমাগত মানুষের আগ্রহ, উৎসাহও বাড়ছে ব্যাপকহারে। আগে স্বাভাবিক নিয়মে প্রাকৃতিকভাবে মাছ উৎপন্ন হতো। এখন সেখানে মানুষ মাছ চাষ করছে। এতে যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তি আর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। এটা শুভ লক্ষণ।
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে নতুন নতুন খাত অর্থনীতির সম্ভাবনাকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলেছে। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের জন্য সুখবর। বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত, প্রবাসীদের অর্জিত আয় তথা রেমিট্যান্স, ওষুধ, অপ্রচলিত পণ্য রফতানি থেকে অর্জিত আয় দেশের অর্থনীতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করছে। সম্প্রতি একাধিক দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ‘এক যুগে দেশে মাছ চাষ বেড়েছে ৫৭ শতাংশ’। একই সঙ্গে বেড়েছে মানুষের মাছ খাওয়ার পরিমাণ, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণও। তাছাড়া মৎস্য উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার বেকার যুবকের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, ২০১০ সালে দেশে মাথাপিছু দৈনিক মাছ খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৪৮ গ্রাম। বর্তমানে মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ গ্রামে। দেশে প্রাণিজ আমিষের ৬০ শতাংশ আসে মাছ থেকে। পাঁচ বছর আগেও যা ছিল ৫০ শতাংশ। ২০০৪ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। রুই, পাঙ্গাশ, কৈসহ বেশ কিছু মাছের দাম দরিদ্র মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যেই রয়েছে। ফলে গত ১০ বছরে দেশে মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ শতভাগ বেড়েছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) মতে, ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বে পুকুরে মাছ চাষ সবচেয়ে বেশি বাড়বে বাংলাদেশে। মৎস্য অধিদফতরের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের বেশি অর্থাৎ ১ কোটি ৮২ লাখ মানুষ মৎস্য সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭৫ হাজার ৩৩৮ টন মৎস্য রফতানি করে ৪ হাজার ২৮৩ কোটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৭২ হাজার ৮৮৮ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৩ হাজার ২৪৩ দশমিক ৪১ কোটি টাকা। দেশের পুকুর ও দীঘিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বার্ষিক হেক্টর প্রতি গড় মৎস্য উৎপাদন ৪ দশমিক ৩৩ টনে উন্নীত হয়েছে, যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ৯৯ টন। চলতি (২০১৬-১৭) অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মেয়াদে হিমায়িত ও জীবিত মাছ রফতানি করে আয় হয়েছে ১৩ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার বা ১ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। মৎস্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী দেশে মাথাপিছু মাছের ভোগ বা খাওয়ার পরিমাণ যা বেড়েছে, তার ৭৬ শতাংশই আসছে পুকুর ও জলাশয় থেকে। ১৯৯০ সালে দেশে মোট চাষকৃত মাছ উৎপাদিত হয়েছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার টন। ২০০০ সালে তা বেড়ে ৬ লাখ ৫৭ হাজার এবং ২০১৫তে এসে ১০ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জাটকাসমৃদ্ধ ১৫টি জেলার ৮০টি উপজেলায় জাটকা আহরণে বিরত ২ লাখ ৩৬ হাজার ১৭৬টি জেলে পরিবারকে মাসিক ৪০ কেজি করে চার মাসের জন্য মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ৩৭ হাজার ৭৮৮ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। জাটকা সংরক্ষণ, অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা এবং ইলিশ প্রজনন সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৩ দশমিক ৮৭ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে, যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ৯৯ লাখ টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৪ লাখ টনে উন্নীত হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মৎস্য উৎপাদন বাড়াতে জেলেদের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় এ বছর জুন পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে ১৫ লাখ জেলের নিবন্ধন করা হয়েছে। এরই মধ্যে ১৩ লাখ ৩০ হাজার জেলের পরিচয়পত্র তৈরি এবং বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে এসপিএফ (প্যাসেফিক প্যাথজেন ফ্রি) বা রোগমুক্ত বাগদা চিংড়ি আমদানির মাধ্যমে চিংড়ির পিএল (পোস্ট লারভে) উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এ কার্যক্রমের আওতায় ২০১৫ সালে প্রায় ৩ কোটি ১০ লাখ এবং ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় ৮ কোটি ৭৬ লাখ পিএল চাষির খামারে বিতরণ করা হয়েছে।
চাষ করা মাছের উৎপাদন ১৮ দশমিক ৬০ লাখ টন থেকে ৪৫ ভাগ এবং জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ৯ দশমিক ৬১ লাখ টন থেকে ২০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলিশ উৎপাদন ৩ দশমিক ৫১ লাখ টন হতে ২০ ভাগ এবং সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন ৫ দশমিক ৮৯ লাখ টন হতে ১৮ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ফিশারিজ বিভাগ রয়েছে। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাছ চাষের নতুন জাত ও উন্নত চাষ পদ্ধতি এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া মৎস্যবিদরা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে মৎস্য চাষিদের সহায়তা দিচ্ছেন। ফলে প্রতিনিয়ত মাছের উৎপাদন বাড়ছে। সূত্রঃ প্রতিদিনের সংবাদ