প্রজনন করার উপযুক্ত সময়
ভেড়ার প্রজনন করানোর উপযুক্ত বয়স নির্ভর করে এর জাত ও ওজনের উপর। গ্রীষ্ম মন্ডলীয় এলাকায় প্রাপ্ত ভেড়ার জাত সমূহ ৫-১২ মাস বয়সে প্রজননক্ষম হয়। এ দেশীয় ভেড়ী সাধারনত ৬-৮ মাস বয়সে প্রজননক্ষম হয়। এই সময় এদের ওজন ১২-১৩ কেজির মত হয়ে থাকে। উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় ভেড়ার পাঁঠা-বাচ্চা ৬-৯ মাসের মধ্যেই বয়ো:প্রাপ্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। তবে তাদেরকে ১২ মাস বয়সের আগে (কমপক্ষে ১৮-২০ কেজি) পাল দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা উচিত নয়। ১০-১২টি ভেড়ীর জন্য ১টি প্রজননক্ষম পাঠীই যথেষ্ট। একটি পাঠীকে তার প্রজননকালে ১০০-২০০ বারের বেশী প্রজনন করানো উচিৎ নয়। ভেড়ী উপযুক্ত দৈহিক ওজন না হওয়া পর্যন্ত পাল দেয়া ঠিক নয়। কারণ কম ওজনের ভেড়ী বাচ্চার মৃত্যুর হার বেশী ভেড়ী যখন প্রথম বার গরম হয় তখন তাকে পাল না দেয়াই ভাল। এক্ষেত্রে ১/২ বার পাল বাদ দিতে হবে। পাল দেয়ার পূর্বে ভেড়ী ঠিকমত গরম হয়েছে কিনা তাহা পর্যবেক্ষন করা প্রয়োজন।
প্রজননের ভেড়া নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয়ঃ
· ভেড়া (পাঁঠা) নির্বাচনের সময় টেবিল ২৪ এ বর্ণিত স্কোর কার্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ভেড়ার পাঠাকে ৬০ বা এর বেশী নম্বর পেতে হবে।
· নির্বাচনের সময় ভেড়ার পাঁঠার বয়স ১২-১৪ মাস (প্রথম জোড়া স্থায়ী দাঁত যুক্ত) বয়সী হতে হবে।
· নির্বাচিত ভেড়ার অধিক উৎপাদনশীল বংশের আকারে বড় ও শৌর্য্য বীর্যশীল হওয়া উচিত (চিত্র ৭৫)
· অন্ডকোষ সুগঠিত এবং পিছনের পা সুঠাম ও শক্তিশালী হতে হবে।
· নির্বাচিত ভেড়ার মা, দাদী এবং নানীকে বছরে দুইবার, প্রতিবারে (৭৫% ক্ষেত্রে) কমপক্ষে ২টি করে বাচ্চা দিতে হবে।
· নির্বাচিত ভেড়ার মা, দাদী ও নানীর বাচ্চা মৃত্যুর হার ৫% এর নিচে হতে হবে।
· নির্বাচিত ভেড়া যৌন রোগ (বিশেষত: ব্রুসেলোসিস) সহ সকল প্রকার রোগ মুক্ত হতে হবে।
ভেড়ী নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয়ঃ
ভেড়ী নির্বাচনে টেবিল ২৫ এ বর্ণিত স্কোর কার্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ৬০ বা এর অধিক নাম্বার প্রাপ্ত ভেড়ীকে বাছাই করা যেতে পারে।
নির্বাচনের সময় ভেড়ীর বয়স ৯-১৩ মাসের মধ্যে হওয়া উচিত।
নির্বাচিত ভেড়ী অধিক উৎপাদনশীল বংশের, আকারে বড়, আর্কষণীয় গঠনের হতে হবে (চিত্র ৭৬)
নির্বাচিত ভেড়ীর মা, দাদী ও নানীর বছরে ২ বার এবং প্রতিবারে নূন্যতম ২টি বাচ্চা দিতে হবে।
নির্বাচিত ভেড়ীর মা, দাদী বা নানীর বাচ্চা মৃত্যুর হার ৫% এর নিচে থাকতে হবে।
নির্বাচিত ভেড়ী কিছুটা ত্রিকোনাকৃতি, পা সামঞ্জস্যপূর্ণ, ওলান অধিক দুধ ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন, বাঁট সামঞ্জস্যপূণ,র্ কিছুটা ভিতরের দিকে বাঁকানো।
নির্বাচিত ভেড়ীর পেট তুলনামূলক বড়, পাঁজরে হাঁড় সম্প্রসারণশীল। দুই পাঁজরের হাঁড়ের মাঝে কম পক্ষে এক আঙ্গুল ফাঁক হবে। এতে ভেড়ী পর্যাপ্ত আঁশ জাতীয় খাবার এবং দুই বা ততোধিক বাচ্চা ধারণ করতে পারবে।
খ) ভেড়ীর গরম হওয়ার লক্ষণ সমূহ
ভেড়ী গরম হলে সোজা ভাবে দাড়িয়ে থাকে, লেজ বাঁকিয়ে রাখে এবং ঘন ঘন লেজ নাড়ে।
ভেড়ীর যোনীদ্বার লাল ও ফোলা হবে এবং যোনীদ্বার দিয়ে সাদাটে মিউকাস বের হবে।
ভেড়ীর খাওয়া দাওয়া কমে যায়, ডাকাডাকি করে ।
গরম হওয়া ভেড়ী ভেড়ার পাঁঠার গা ঘেসে অবস্থান করে।
অন্যান্য প্রজাতি যেমন ছাগী অন্য ছাগীর উপর লাফ দেয় কিন্ত ভেড়ার ক্ষেত্রে তা সাধারণতঃ দেখা যায় না।
ভেড়ী গরম হওয়ার ১২ ঘন্টা পর অর্থাৎ সকালে গরম হলে বিকেলে এবং বিকেলে গরম হলে পরদিন সকালে পাল দিতে হবে।
গ) প্রসবের সময় ভেড়ী ও বাচ্চার যত্ন
প্রসবের সাথে সাথে বাচ্চার সমস্ত শরীরে বিশেষত নাকে শ্লেস্মা সরিয়ে নাকের মধ্যে ফু দিয়ে বাচ্চার শ্বাস প্রশ্বাসে সহায়তা করতে হবে।
পায়ের খুর এবং নাভি কাটার (শরীর থেকে দুই আঙ্গুল নিচে) পর সেখানে টিংচার-অব-আয়োডিন দিয়ে মুছে দিতে হবে।
বাচ্চাকে
মায়ের সামনে রাখতে হবে যাতে মা সহজে বাচ্চাকে চেটে পরিস্কার করতে পারে। প্রয়োজনে শুকনো খড় বা গামছা দিয়েও বাচ্চাকে দ্রুত পরিস্কার করা যেতে পারে।
দুই বা ততোধিক বাচ্চা প্রদানের ক্ষেত্রে মাকে প্রতিটি বাচ্চা প্রসবের পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে।
বাচ্চাকে মোটামুটি পরিস্কার করে দ্রুত শাল দুধ খাওয়াতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি বাচ্চা যেন শালদুধ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
শীতকালে যখন তাপমাত্রা ২০০ সেঃ এর নিচে থাকে অথবা বাচ্চা যদি শীতে কাঁপতে থাকে তখন বাচ্চাকে সাথে সাথে উষ্ণ স্থানে (তাপমাত্রা ৩০০ সেঃ) বা রোদে রেখে গরম করতে হবে।
q বাচ্চা প্রসবের পর ভেড়ীকে স্যালাইন গোলানো পানি (প্রতিলিটার পানিতে ২০ গ্রাম চিটাগুড় এবং ২ গ্রাম লবন) ২-৩ লিটার হারে পান করতে দিতে হবে। ভেড়ীকে এ সময়ে জাউসহ ভাল ঘাস সরবরাহ করতে হবে।
ভেড়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
সুস্থ্য ভেড়া লাভজনক খামার পরিচালনার পূর্ব শর্ত। রোগের কারণে বিভিন্নভাবে খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রোগাক্রান্ত ভেড়ার দৈহিক বৃদ্ধি, বাচচা ও দুধ উৎপাদন কম হয়। এই জন্য ভেড়ার খামারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভেড়ার অসুসহ্যতা নির্ণয়ের পূর্বে সুস্থ্য ভেড়ার কি লক্ষণ হবে তা জানা উচিত।
ক.
ভেড়া দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। সাধারণত: পালের একটি ভেড়া যে দিকে চলে দলের অন্য ভেড়া তাকে অনুসরণ করে। সুস্থ্য ভেড়া এক মনে খাদ্য গ্রহণ করে।
সুস্থ্য ভেড়ার মাথা শরীরের সাথে সমান্তরালভাবে থাকে এবং সবসময় সাবলীল ভঙ্গিতে চলাফেরা করে। কোন আগমতুক এলে সাবলীল ভঙ্গিমায় মাথা উঁচু করে তাকাবে এবং কিছুক্ষণ পর পূণ:রায় খাদ্য গ্রহণ শুরু করবে।
নাক এবং চোখ পরিচছন্ন থাকবে এতে কোন ময়লা থাকবে না। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে পালিত সুস্থ্য ভেড়ার চামড়া বিশেষ করে যে সকল অংশ পশমে আবৃত নয় সে সকল অংশ উজ্জ্বল নরম থাকে।
এদের পাগুলি শক্ত ও সুঠাম গড়নের হবে। কোন রকম খুঁড়িয়ে চলবে না। সুস্থ্য ভেড়ার পায়খানা দানাদার হবে এবং পায়ু অঞ্চল পরিচছন্ন থাকবে। প্রশ্রাবের রং থাকবে শুকনা খড়ের রংয়ের মত। দুধের বাঁট এবং ওলান নরম ও স্পঞ্জের মত হবে। বাঁটে বা ওলানে কোন দানা বা শক্ত কিছু থাকবে না।
একটি সুস্থ্য ভেড়ার স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতি মিনিটে নাড়ী স্পন্দন এর হার ৭০-৯০, শ্বাস প্রশ্বাসের হার প্রতি মিনিট ১০-২০ এবং দেহের তাপমাত্রা ৩৯০ সেঃ বা ১০২০ ফাঃ হয়ে থাকে।
চোখে বা মুখের ভিতরের মিউকাস মেমব্রন সব সময় উজ্জ্বল থাকবে, অতিরিক্ত লাল বা ফ্যাকাসে অবস্থা বিভিন্ন রোগের লক্ষণ হতে পারে। ভেড়ার পেটের স্পন্দন (Rumen movement) স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতি ৫ মিনিটে ৫-৭ বার হয়ে থাকে।
খ) ভেড়ার অসুস্থ্যতার লক্ষণ সমূহ
ভেড়ার অসুস্থ্যতাকে সাধারনভাবে রোগ বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ শরীর অথবা কোন অঙ্গের যে কোন পরিবর্তন যা দেহের স্বাভাবিক কাজের ব্যাঘাত ঘটায় তাই রোগ। দেহের স্বাভাবিক কাজ কর্মের পরিবর্তনের মাধ্যমে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
বিভিন্ন কারনে রোগ হতে
পারে। খামারে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার প্রধান কারণ ধকল (Stress)। ধকলের কারণ সাধারণত: অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম, অপর্যাপ্ত বায়ু প্রবাহ, স্থানের তুলনায় অধিক ভেড়ার ঘনত্ব, অপর্যাপ্ত খাদ্য এবং পানি।
কখনো কখনো অতিরিক্ত ঔষধ প্রয়োগের ফলেও ভেড়া অসুসহ্য হতে পারে। এ সবের কারণে পশু দূর্বল হয়ে পড়ে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং সহজেই রোগাক্রান্ত হয়।
এছাড়াও কোন কোন রোগ ভেড়ায় অন্য রোগ হওয়ার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকে। যেমন কৃমি, যা পশুকে ধীরে ধীরে দূর্বল করার মাধ্যমে অন্য সংক্রামক রোগাক্রমনের ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে থাকে।
ভেড়া অসুস্থ্য হলে অন্য ভেড়ার সাথে চলাফেরা বা খাদ্য গ্রহণ না করে এককভাবে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকে। কেউ কাছে গেলে, এলোমেলোভাবে এদিক ওদিক দৌঁড় দেয়। সূত্র – ফার্মসএন্ডফার্মার ২৪