ভূমিকা : বাংলাদেশ অসংখ্য নদ-নদী, হাওড়-বাঁওড়, খাল-বিল, পুকুর-দিখি ইত্যাদি বৈচিত্রময় জলাশয়ে যেমন সমৃদ্ধ তেমনি নানা প্রজাতির মাছে ভরপুর। প্রতিনিয়ত আমাদের মাছ চাষে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রজাতির মাছ। এ ধারাবাহিকতায় যুক্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাছ। যার মধ্যে গুলশা অন্যতম। এ মাছটি অত্যন্ত সুস্বাদু এবং এর ব্যাপক বাজার চাহিদা রয়েছে। মাছ চাষিদের ভাগ্য পরিবর্তনের অদম্য প্রচেষ্টা ও মৎস্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাংলাদেশকে চাষের মাছ উৎপাদনে সারা পৃথিবীতে একটি সম্মানজনক অবস্থানে আসীন করেছে। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠির প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ নিশ্চিত করতে মাছচাষ পদ্ধতিকে আধুনিকীকরণ করার কারণে ছোট মাছ চাষের প্রতি চাষীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। পরিচিত দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে গুলশা মাছ সকলের প্রিয় এবং এর বাজারমূল্যও বেশী। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিভিন্ন হ্যাচারিতে এই মাছের পর্যাপ্ত পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির উচ্চমূল্যের এ মাছ চাষের প্রযুক্তি সম্প্রসারণ সময়ের দাবি। দেশের চাহিদা পূরণ করে অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারলে এ মাছ বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে।
গুলশা মাছের পুষ্টিমান
গুলশা মাছ প্রতি ১০০ গ্রামে আমিষ ১৯.২ গ্রাম, লৌহ ০.৩০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.২৭ গ্রাম, চর্বি ৬.৫ গ্রাম, শর্করা ১.১ গ্রাম, ফসফরাস ০.১৭ গ্রাম।
গুলশা মাছের বৈশিষ্ট্য
● গুলশা মাছের বৈজ্ঞানিক নাম: Mystus bleekeri স্থানীয় নামঃ গুলশা;
● এই মাছে প্রচুর আমিষ ও পর্যাপ্ত অণুপুষ্টি আছে,
● গুলশা মাছের দেহ আঁইশ-বিহীন, চকচকে, উজ্জ্বল রূপালী বর্ণের;
● গুলশা মাছ সর্বভূক,
● গুলশা মাছের প্রজনন মৌসুম বেশ দীর্ঘ (মধ্য ফেব্রুয়ারী সেপ্টেম্বর) তবে এপ্রিল-আগষ্ট মাস এই মাছের প্রজননের সর্বোত্তম মৌসুমঃ
● গুলশা মাছ ১ বছরে পরিপক্কতা লাভ করে, তবে দুই বছর বয়সী ব্রুড মাছ কৃত্রিম প্রজননে বেশী উপযোগী।
● একটি ২৮-৫২ গ্রাম ওজনের গুলশা মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৬০০০-২২০০০টি;
● এই মাছে কাঁটা খুবই কম যার জন্য সকলের নিকট প্রিয়;
● কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সহজেই পোনা উৎপাদন করা যায়:
খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস
গুলশা মাছ কাইরোনমিড লার্ভা, টিউবিফেক্স ওয়ার্ম, কুচো চিংড়ি, কেঁচো, জলজ পোকা-মাকড়, শ্যাওলা ও পাতার নরম অংশ খায়। এ মাছ সর্বভূক, বটম ফিডার এবং সম্পূরক খাদ্য হিসাবে সরিষার খৈল, চালের কুড়া, ফিসমিল দিয়ে তৈরি খাবার খায়। শিল্প কল কারখানায় তৈরি ভাসমান খাবার খেয়ে এ মাছ দ্রুত বড় হয়। গুলশা মাছ নিশাচর তাই রাতে খাদ্য গ্রহণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
গুলশা মাছ চাষের সুবিধা
● গুলশা মাছ একক বা রুই জাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষ করা যায় এবং মিশ্র চাষের সফলতা বেশি;
●গুলশা মাছ ছোট, মাঝারি, বড়, বাৎসরিক / মৌসুমী ইত্যাদি প্রায় সব ধরনের পুকুরেই চাষ করা যায়;
● চাহিদা ও বাজার মূল্য বেশী থাকায় এই মাছ চাষে বেশী আয় করা সম্ভব;
● অল্প সময়ে চাষ করা যায় এবং ৫-৬ মাসেই বিক্রয় উপযোগী হয়;
● ৩০-১০০ শতাংশের পুকুর এ মাছ চাষের উপযোগী এবং পানির গভীরতা ১-১.৫ মিটার হলে ভালো হয়;
• অক্সিজেনযুক্ত ব্যাগে জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করা যায়;
● গুলশা মাছের মিশ্র চাষে রোগ-বালাই কম হয়।
গুলশা মাছ চাষের পুকুরে উল্লেখযোগ্য ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলী:
● পানির পিএইচ ৭-৮ মাত্রা, পানির স্বচ্ছতা ২৪-২৬ সে.মি. সেক্কি, খরতা ৮০-২০০ মি.গ্রা/লিটার,
● তাপমাত্রা ২৫-৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস;
● অক্সিজেনের মাত্রা ৫ পিপিএম এর উপরে থাকতে হবে;
মজুদ পূর্ব ব্যবস্থাপনা
পুকুর প্রস্তুতি
● পুকুর শুকানো, তলদেশের কাদা ও জৈব অবশেষ অপসারণ;
● গুলশা মাছের পুকুরে ১:১.৫ ঢাল সর্বোত্তম:
● পুকুরের তলা মই দিয়ে সমান করে দেয়া ভাল:
● পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে রোটেনন প্রয়োগ করে। রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা যায়। রোটেনন ব্যবহার না করলে মিহি ফাসের জাল বার বার টেনে এদের দূর করতে হবে। রোটেনন ২৫-৩০ গ্রাম/শতাংশ/ ফুট পানিতে প্রয়োগ করতে হবে। বিষক্রিয়ার মাত্রা ৫-৭
● পুকুরের তলদেশ ভিজা থাকা অবস্থায় ১কেজি হারে চুন দিতে হয়। তবে দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটির চেয়ে লাল মাটি, এটেল মাটি ও কালচে কাদামাটি অধিক অধর্মী হওয়ায় অধিক মাত্রায় চুন প্রয়োগ করতে হবে।
● ভালভাবে মাছচাষ করার জন্য পুকুরের পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা থাকা উত্তম;
● পুকুরের পাড়ের চারপাশে নাইলন নেটের বেড়া দিয়ে সাপ, ব্যাঙ, গুইসাপ ও অন্যান্য অবাঞ্ছিত প্রাণীর অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে;
● শিকারী পাখি যেমন বাজ, বক, পানকৌড়ি পাখির আক্রমন থেকে মাছকে রক্ষার জন্য পুকুরের উপরে নেট দেয়া যেতে পারে;
গুলশা মাছ চাষের ক্ষেত্রে সাধারণত কোন সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরীর প্রয়োজনে প্রতি শতাংশে চাউলের মিহি কুড়া ২০০ গ্রাম, চিটাগুড় ২০০ গ্রাম, ইষ্ট ৫ গ্রাম একত্রে ৩ গুণ পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে পানি ছেঁকে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। ঐ ছাকনিতে থাকা অবশিষ্ট উপাদান গুলো পুনরায় ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে পর পর ৩ দিন প্রয়োগ করলে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদিত হবে।
মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা
সুস্থ সবল গুলশা মাছের পোনার বৈশিষ্ট্য
● পোনার গা পিচ্ছিল, লেজ বক্ষ পাখনার কাঁটা ও অন্যান্য পাখনা অক্ষত থাকবে;
● গায়ে কোন ক্ষত চিহ্ন থাকবে না;
● স্রোতের বিপরীতে চলে;
● গাত্র বর্ণ উজ্জ্বল ও চকচকে, পিঠের দিকে কালচে বর্ণের হবে:
পোনা পরিবহণ
● গুলশা মাছের পোনা ড্রামে পরিবহণ করা যায়;
● ২-৪ সে. মি. আকারের পোনা অক্সিজেন যুক্ত ব্যাগে (৩৬″×২২”x২৪”) ব্যাগ প্রতি ১০০০ টি হারে ৪-৬ ঘন্টার দূরত্বে পরিবহণ করা যায়। পোনার আকার ৪-৫ সে. মি. হলে একই সময়ের দূরত্বে ৫০০টি পোনা ঐ ব্যাগে পরিবহণ করা যায়;
● পোনা ভাল রাখার জন্য ৪-৫ লিটার পানির প্রতি ২০টি ব্যাগের জন্য ১০ গ্রাম অক্সিজেন পাউডার, ১ প্যাকেট ওরস্যালাইন ও মাল্টিভিটামিন বা ভিটামিন-সি ১০ গ্রাম হারে পৃথকভাবে গুলিয়ে ২০ ব্যাগে সমহারে ভাগ করে। দিতে হবে;
● গুলশার পোনা রাতে পরিবহণ করা ভাল: সরবরাহের উদ্দেশ্যে পোনা ধরার আগের দিন বিকেল থেকে খাদ্য প্রদান বন্ধ রাখতে হবে এবং
● ট্যাংক বা সিস্টার্নে ৮-১২ ঘন্টা ঝরণা ধারায় রেখে টেকসই করতে হবে;
■ যে সকল পুকুরে এ্যারেশন, পানি পরিবর্তন এবং তলানি অপসারণের ব্যবস্থা আছে সে সকল পুকুরে শতকে ২০০০- ২৫০০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে;
■ পুকুরের ধারণ ক্ষমতা বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনে আংশিক আহরণ করতে হবে;
■ গুলশা মাছের সাথে অন্যান্য ছোট প্রজাতির (শিং, পাবদা, টেংরা) মাছ চাষ করলে পাবদা পরে ছাড়তে হবে বা গুলশার চেয়ে পাবদার পোনার আকার ছোট হতে হবে:
■ পোনা ছাড়ার সময় পুকুরের পানির তাপমাত্রার সাথে ধীরে ধীরে খাপ খাওয়াতে হবে:
■ পোনা শোষনের জন্য পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেটে (১০ লিটার পানিতে ১ চা চামচ) গোসল করাতে হবে অথবা ২০০ গ্রাম লবণ ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৩০ সেকেন্ড গোসল করিয়ে ছাড়তে হবে;
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
পোনা মজুদের পরদিন থেকে মাছের মোট ওজনের শতকরা ৩০ ভাগ থেকে শুরু করে মাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে কমিয়ে শতকরা ৩ ভাগ হারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে:
■ ভাসমান খাবার দিয়ে এ মাছ চাষ করতে হয় তবে রুই জাতীয় মাছের সাথে সাথী ফসল হিসেবে মিশ্র চাষ করলে রুই জাতীয় মাছের জন্য ভিজা বা ডুবন্ত খাবার ব্যবহার করা যেতে পারে:
গুলশা মাছের আকার ১-১.৫ ইঞ্চি পর্যন্ত ৩৫-৪০% আমিষ যুক্ত পাউডার খাবার খাওয়াতে হবে, পরবর্তীতে আমিষের পরিমান কমিয়ে ৩০-৩৫% আমিষ সমৃদ্ধ খাবার দেয়া যেতে পারে;
■ মাছের আকারের উপর ভিত্তি করে ০.৫ মি.মি. ২. মি.মি. আকারের ভাসমান দানাদার খাবার দিতে হবে;
■ গুলশা মাছ নিশাচর এবং রাতে খাবার খেতে পছন্দ করে। তাই শেষ রাতে ও সন্ধ্যা রাতে দৈনিক দুইবার খাবার দিতে হবে:
■ সাধারণত ভাসমান খাবার প্রয়োগ করলে ১৫-২০ মিনিট ধরে যে পরিমাণ খাবার খাবে সে পরিমাণ খাবার সরবরাহ করাই নিরাপদ,
■ মেঘলা আবহাওয়া এবং তাপমাত্রা কম থাকলে (শীত কালে) খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে:
■ কোনভাবেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার দেয়া যাবে না।
■ কোনভাবেই জাল টেনে ধরে যাবে কারণ গুলশা মাছের অসাবধানতাবসত মাছের কাঁটার আঘাতে মাছের গায়ে ক্ষত হতে পারে এবং সেখান থেকে সংক্রমণ সকল ছড়িয়ে পড়তে পারে:
সাধারণত খাবার গুলশা পানির উপরে চলে আসে দেখে আমাদের করতে হবে কত বড় হয়েছে বা তাদের সাড়া দেখে বুঝতে হবে মাছ কেমন খুব প্রয়োজন হলে ঠেলা জাল দিয়ে কয়েকটি মাছ ধরে পর্যবেক্ষণ যেতে পারে;
পরিচর্যা
মাছের নিরাপদ
সপ্তাহে বার বেলা ১১-১২ সময় পুকুরে হররা টানতে হবে: কোন পানি ঝরণাকারে দিতে হবে;
পুকুরে পানি গেলে বাহির পানি সরবরাহ করতে হবে; পানির স্বচ্ছতা ২৪-২৬ সে.মি. হবে:
মাছের ১০-১৫ দিন পর পর খাদ্যের সাথে ভিটামিনের প্রিমিক্স মিশিয়ে খাওয়াতে হবে;
প্রতি একবার সকাল ৮-৯ টার পানির সাথে ভালো করে গুলিয়ে দিতে হবে;
অধিকতর ২০০-৩০০ গ্রাম লবণ দিতে হবে:
■ পুকুরের তলদেশের গ্যাস দূর দিতে হবে:
মাছ আহরণ ও উৎপাদন
গুলশা মাছ ৬-৭ মাসে কেজিতে ৩৫-৪০টি পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাছ আহরণকালে পুকুরের সমস্ত পানি শুকিয়ে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণত কেবল জাল দিয়ে সমস্ত গুলশা মাছ ধরা যায় না। আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে গুলশা মাছ চাষ করে ৬-৭ মাসে হেক্টরে ৪৫০০-৫০০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়। বাজারজাত করণ
■ গুলশা মাছ জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করলে বাজারমূল্য বেশী পাওয়া যায়;
■ জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করার জন্য গুলশা মাছ আহরণের পর হাউজ বা ট্যাংকে ৮-১২ ঘন্টা পানির ঝরণা ধারার রাখতে হয়;
সতর্কতা
■ গুলশা চাষের ক্ষেত্রে চাষীদেরকে দ্রবীভূত অক্সিজেনের স্বল্পতা প্রতিরোধে সোডিয়াম পার কার্বোনেট বা গ্যাস নিবারক সংগ্রহে রাখা প্রয়োজন;
■ পানির pH ৮ এর উপর হলে তা কমানোর ব্যবস্থা হিসেবে পানি পরিবর্তন করা বা তেতুল ব্যবহার করা বা শতকে ১ কেজি হারে জিপসাম প্রয়োগ করা যেতে পারে;
■ পানি যাতে বেশি সবুজ না হয়ে যায় সে দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে;
■ সবসময় সম আকারের পোনা ছাড়তে হবে;
■ অনেক সময় মাছের খাবার গ্রহণের হার কমে যেতে পারে, এ ক্ষেত্রে পুকুরে পানি পরিবর্তন করা যেতে পারে;
■ মাছ চাষে কোন প্রকার সমস্যা দেখা দিলে স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
মৎস্যবাংলাদেশ