সাত বছর বয়সী কাতলা মাছটির ওজন ১৮ কেজি। সেই মাছটির অর্থনৈতিক অবদান বের করতে গবেষণা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে। এই মাছকে নমুনা ধরে হালদা নদীতে ১০ বছরে প্রাপ্ত মা মাছ ও ডিমের গড় করা হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, একটি মাছ সাধারণত ১৬ বছর বাঁচে। এর মধ্যে সেটি পূর্ণাঙ্গ ডিম দেয় ১০ বছর। সেই ডিম থেকে রেণু এবং রেণু থেকে বড় মাছ উৎপাদন পর্যন্ত সব ধাপ বিবেচনায় নিলে একটি মা মাছ থেকে প্রতিবছর আয় হয় প্রায় ৪ কোটি টাকা। এই হিসাবে হালদা থেকে বছরে অর্থনীতিতে যোগ হয় ৮২১ কোটি টাকা।
বয়স ও ওজনভেদে একটি মাছ প্রতিবছর ৫ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। ডিম থেকে ফোটা রেণু বিক্রি হয় বিভিন্ন ধাপে। এক কেজি রেণুর সর্বনিম্ন দাম ৩৫ হাজার টাকা, সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা। প্রথম ধাপে মাছের ডিম থেকে রেণু ফোটে চার দিনের মধ্যে। দ্বিতীয় ধাপে রেণু বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ দিনে। এটিকে বলা হয়, ধানী পোনা। তৃতীয় ধাপে বিক্রি হয় আঙ্গুলি পোনা।
এগুলো এক থেকে দু’মাস বয়সী। চতুর্থ ধাপে একটি রেণু পরিপূর্ণ মাছে পরিণত হয়। প্রতিটি ধাপে ৪০ শতাংশ মৃত্যু হার ধরে কাতলা মাছটির অর্থনৈতিক মূল্য বের করেন গবেষকরা। তাঁদের হিসাবে এ মাছটি পাঁচ বছরে অর্থনীতিতে যোগ করেছে প্রায় ২০ কোটি টাকা।
হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও চবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, হালদাই বাংলাদেশে কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। এটি বিশ্বের একমাত্র নদী, যেখানে জোয়ার-ভাটার মধ্যেই সরাসরি নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। প্রতিবছর একটি সময়ে এ নদীতে রুই, কাতলা, মৃগেল জাতীয় মা মাছ দলে দলে আসে ডিম ছাড়তে। সেই ডিম সংগ্রহ করে রেণু ফোটান জেলেরা। রেণু যায় টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত।
যেভাবে অবদান রাখছে হালদা
১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত হালদা থেকে গড়ে প্রতিবছর ৩০ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার রেণু পাওয়া গেছে। এর পরিমাণ প্রায় ৬০৪ দশমিক ৬৪ কেজি। প্রতি কেজি রেণুর দাম ৩৫ হাজার টাকা ধরলে বাজারমূল্য দাঁড়ায় ২ কোটি ১১ লাখ ৬২ হাজার ৪০০ টাকা। ৪০ শতাংশ মৃত্যু হার ধরে হিসাব করলে দ্বিতীয় ধাপে দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৬০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। তৃতীয় ধাপে আবার ৪০ শতাংশ মৃত্যু হার ধরলে পোনার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ কোটি ৮৮ লাখ ৩৫ হাজার ২০০। প্রতি কেজি পোনার দাম দুই লাখ টাকা ধরলে তৃতীয় ধাপে আয় হয় ২১ কোটি ৭৬ লাখ ৭০ হাজার ৪০০ টাকা। চতুর্থ ধাপে ৪০ শতাংশ মৃত্যুহার ধরলে পোনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ কোটি ৫৩ লাখ ১ হাজার। হালদার পোনা চাষ করলে বছরে গড়ে এক কেজি হয়। এই হিসাবে মাছের পরিমাণ ৬ কোটি ৫৩ লাখ ১ হাজার কেজি। প্রতি কেজির দাম সর্বনিম্ন ১২০ টাকা ধরে গবেষকরা বলছেন এই ধাপে আয় দাঁড়ায় ৭৮৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে হালদা থেকে বছরে ৮২১ কোটি ১০ লাখ টাকা টার্নওভার হয়। এটি দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৬ শতাংশ।
ভাগ্য বদলাচ্ছে ২৯ ইউনিয়নের বাসিন্দার
হালদা নদী খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার বদনাতলি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এটি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রায় ৯৮ কিলোমিটার অতিক্রম করে চট্টগ্রাম শহরের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীতে মিলিত হয়েছে। হালদার মূল স্রোতের সঙ্গে বিভিন্ন পাহাড়ি ছড়া মিলিত হয়ে এটিকে সমৃদ্ধ করেছে। উৎসমুখের পর থেকে ২০টি বড় খাল বা ছড়া ও প্রায় ৩৪টি ছোট পাহাড়ি ছড়া মিশেছে।
হালদাকে কেন্দ্র করে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দু’পাড়ের প্রায় ১ হাজার ৫৪৪ জন জেলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হালদার ওপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করেন। এ ছাড়াও রয়েছেন ১ হাজার ৮৯ জনের মতো ডিম সংগ্রহকারী, যাঁদের প্রায় ৫২৪টি নৌকা প্রতি বছর ডিম সংগ্রহের কাজে লাগে। প্রতিটি নৌকার জন্য খরচ হয় বছরে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করে সারাদেশে বিক্রি করেন জেলেরা। হালদার মাছ খুব দ্রুত বড় হয়। এটি সুস্বাদু। তাই সারাদেশে এ জাতীয় মাছের কদর বেশি। নদী থেকে সংগ্রহ করা ডিম থেকে রেণু ফুটিয়ে বিক্রি করে দোতলা বাড়ি করেছেন আবুল কাশেম। বছর দশেক আগেও তাঁর ছিল কুঁড়েঘর। এখন তার নিজস্ব নৌকা আছে। এ ছাড়া বদলে গেছে পরিমল, জাহাঙ্গীরসহ অনেকের জীবন।
আয়ে রেকর্ড হবে এবার
হালদা নদীতে এবার ১৬ হাজার থেকে ১৭ হাজার কেজি ডিম পাওয়া গেছে। প্রতি ৬০ কেজি ডিম থেকে ৪ দিন বয়সী ১ কেজি রেণু পাওয়া যায়। এই নদী থেকে ২০২২ সালে ৫ থেকে ৬ হাজার কেজি ডিম পাওয়া গেছে। ২০২১ সালেও কম ছিল ডিমের পরিমাণ। এবার আয়ে রেকর্ড হবে। ডিম সংগ্রহকারী রোসাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এবার নদীতে মা মাছ ডিম ছেড়েছে পুরোদমে। উৎসবমুখর পরিবেশে ডিম সংগ্রহ করেছি। এবারে সংগৃহীত ডিম পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারব।’ অনিমেশ দাশ বলেন, ‘১৩ বালতি ডিম সংগ্রহ করেছি। এক মাস পর রেণু বিক্রি করব। তখন রেণুর দাম বেশি থাকে। প্রতি কেজি রেণু লাখ টাকার ওপরে বিক্রি করতে পারব বলে আশা করছি।’
সূত্র: সমকাল।