বর্ধনশীল জি-৩ জাতের রুই মাছ চাষে যশোরের চাষিদের সাফল্য
মীর কামরুজ্জামান, যশোর: রুই মাছের নতুন এক জাত জি-৩। হালদা, পদ্মা ও যমুনা নদীর রুই মাছ থেকে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তিন বার জেনেটিক পরিবর্তন করে উদ্ভাবন করা হয়েছে এ জাত। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ উদ্ভাবিত ‘তৃতীয় প্রজন্ম ’ বা জি-৩ কম খাবার খায়, পুষ্ট বেশি ও দেখতে উজ্জ্বল। দেশি রুইয়ের মতোই স্বাদের অধিক বর্ধনশীল এ জি-৩ মাছের পরীক্ষামূলক চাষে যশোরে চাষি পর্যায়ে ব্যাপক সফলতা দেখা গেছে। প্রচলিত অন্যান্য জাতের মাছের চেয়ে ৩০ থেকে ৩৭ শতাংশ বর্ধনশীল এ মাছ চাষে ব্যাপক আশা দেখছেন যশোরের মাছ চাষিরা। শহরের চাঁচড়া মৎস্য পল্লিসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় এ বছর জি-৩ চাষে অভাবনীয় সফলতা পেয়েছেন তারা। খুব দ্রুত সারাদেশের মাছ চাষিদের মধ্যে নতুন এ জাতটি ছড়িয়ে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, হালদা, পদ্মা ও যমুনা নদী থেকে সংগ্রহ করা রুই মাছের ডিমের জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের মাধ্যমে উন্নত জাত উদ্ভাবনে ওয়ার্ল্ড ফিশের এ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১২ সালে। পরে দেশের মৎস্য খামারগুলোর সবচেয়ে বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করা খুলনা বিভাগের ১০টি ও রাজশাহী বিভাগের ৯টি খামারে পরীক্ষামূলকভাবে রুইয়ের জি-৩ জাতের মাছের উৎপাদন সম্ভাবনা জানতে চাষ করা হয়। সেখানে হালদা, পদ্মা ও যমুনা নদীর প্রাকৃতিক রুইয়ের ডিম, দেশের একটি হ্যাচারি থেকে বাণিজ্যিক চাষের জন্য ব্যবহার করা ডিম ও ওয়ার্ল্ড ফিশের জেনেটিকালি মোডিফায়েড ডিম থেকে পোনা উৎপাদন করে মাছ বড় করা হয়। পরীক্ষায় দেখা যায়, ওই ১৯টি খামারে জি-৩ জাতের রুই সবচেয়ে দ্রুত বড় হয়েছে এবং অন্য জাতের চেয়ে এ জাতের মাছের ওজন গড়ে ৩৭ শতাংশ বেশি।
যশোর জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড ফিশ উদ্ভাবিত জি-৩ রেণু ও পোনা যশোরে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ফিশ কার্প জেনেটিক ইমপ্রুভমেন্ট কেন্দ্রের ৫৪টি হাপায় লালন-পালন করা হয়। মাছগুলো উপযুক্ত আকারে উপনীত হলে মেশিনের সাহায্যে শনাক্তকরণের জন্য ‘প্যাসিভ ইন্টিগ্রেটেড ট্রান্সপোনডার’ বা পিট নামক এক প্রকার যন্ত্রের সাহায্যে চিহ্নিত করা হয়। তারপর পোনা মাছগুলো একত্রে একটি পুকুরে চাষ করা হয়। পরীক্ষামূলক চাষের ফলাফলের পর তৃতীয় প্রজšে§র এ জি-৩ রুই মাছ একই বছরে যশোরের ৬ জন হ্যাচারি মালিকের মধ্যে প্রত্যেককে ২০০ গ্রাম করে ওই মাছের রেণু দেয়া হয়। এরপর সেই রেণুগুলো হ্যাচারিতে বড় করে তাদের নিজস্ব পুকুরে চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন চাষিদের মধ্যে সরবরাহ করেন।
এ ব্যাপারে যশোর চাঁচড়া সবজিবাগ এলাকার রুপালি ফিশ হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী শেখ মেজবাহ উদ্দীন বলেন, জি-৩ রুই মাছ প্রচলিত রুই মাছের চেয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩৭ শতাংশ বেশি বৃদ্ধি পায়। প্রাথমিকভাবে আমি এই মাছের চাষ করেছি এবং আরও কিছু চাষির মধ্যে এ মাছের পোনা সরবরাহ করেছি। প্রথম বছরেই মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে প্রতিটি মাছ ৩ কেজি ৫০ গ্রাম ওজন হয়েছে। তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে চাঁচড়ার ফাহাদ মৎস্য হ্যাচারির ফারুক নামে আরেকজন মাছচাষি ৪ হাজার পিস এ মাছের পোনা নিয়ে পুকুরে চাষ করেন। তার পুকুরে প্রতি মাছই ১১ মাসের ব্যবধানে ৩ থেকে সাড়ে তিন কেজি ওজন হয়েছে। কোনোটা এর চেয়েও বেশি হয়েছে বলে তিনি জানান।
প্রায় একই কথা বলেন, চাঁচড়া মাতৃ ফিশ হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী জাহিদুর রহমান গোলদার। তিনি বলেন, ওয়ার্ল্ড ফিশ উদ্ভাবিত তৃতীয় প্রজšে§র এ মাছ যশোরের চাষি পর্যায়ে বেশ সাড়া ফেলেছে। তিনি বলেন, প্রথমদিকে এ মাছ চাষে চাষিদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। এখন অনেকেই এ মাছ চাষের প্রতি ঝুঁকছেন। তিনি বলেন, এ মাছগুলো হালদা, পদ্মা ও যমুনা নদী থেকে উৎপন্ন রুই মাছ এবং বাণিজ্যিকভাবে সমাদৃত একটি হ্যাচারি থেকে সংগৃহীত। যে কারণে সহজেই মাছ চাষিরা উন্নত জাতের মাছের পোনা বা রেণু পাচ্ছেন। এ কারণে তারা কোনো ঝুঁকি ছাড়াই এ মাছ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
চাঁচড়া মা ফাতিমা ফিশ হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী আলহাজ ফিরোজ খান বলেন, জি-৩ রুই মাছ বাংলাদেশের মাছ চাষকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমার দীর্ঘ মাছ চাষের জীবনে এমন বেশি বর্ধনশীল মাছ আর কখনও দেখিনি। আমরা চাঁচড়ার ৬ জন হ্যাচারি মালিক এ মাছ চাষ করে ব্যাপক লাভবান হয়েছি। আমার পুকুরে এখনও জি-৩-এর ৪৬০০ ব্রুড রয়েছে। যার প্রতিটিই তিন কেজির ওপরে ওজন।
এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ড ফিশ যশোরের ফিশ ব্রিডিং অ্যান্ড রিসার্চ প্ল্যাটফার্ম ম্যানেজার মাসুদ আকতার বলেন, পরীক্ষামূলক চাষের ফলাফলের পর ২০২০ ও ২০২১ সালে কিছুসংখ্যক হ্যাচারি ও নার্সারিকে জি-৩ রুই মাছের জাত সরবরাহ করা হয়। এর পাশাপাশি ওয়ার্ল্ড ফিশ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে ১৯টি আধা-বাণিজ্যিক খামারে জি-৩ রুই মাছের পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করে। পরে প্রতি মাসে নমুনায়ন পদ্ধতিতে মাছের বৃদ্ধির হার পর্যবেক্ষণ করা হয়। তিনি বলেন, যশোরে ৬টি হ্যাচারিতে এ মাছের রেণু সরবরাহ করা হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি হ্যাচারি মালিক এ রেণু থেকে পোনা বানিয়ে তা পুকুরে চাষ করে ব্যাপক সফল হয়েছেন। তিনি বলেন, ওয়ার্ল্ড ফিশ উদ্ভাবিত জি-৩ রুই আগামী দিনে বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
এদিকে ওয়ার্ল্ডফিশ উদ্ভাবিত জি-৩ রুই মাছ চাষকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে জেলা মৎস্য বিভাগ। এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ফিরোজ আহমেদ বলেন, তৃতীয় প্রজন্ম এ মাছ চাষ চাষি পর্যায়ে সম্প্রসারণে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা মাঠ পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করে দেখেছি, অধিক বর্ধনশীল এ মাছ চাষ কৃষক পর্যায়ে বেশ সাড়া ফেলেছে। তিনি বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ঠিক একই পদ্ধতিতে দ্রুতবর্ধনশীল মাছের জাত নির্ণয় করে সেখানকার চাষিরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। আশা করছি, বাংলাদেশের মাছ চাষিরাও এর মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবেন।
copy right : share bij