লেয়ার মুরগির খামার স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো লাভজনকভাবে ডিম উৎপাদন করা। এ জন্য দরকার একটি মুরগির উৎপাদন সক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকাশ বা প্রদর্শনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা। নানাবিধ কারণে কোন একটি মুরগির ফ্লক থেকে যে পরিমান ডিম পাওয়ার কথা অনেক সময় তা পাওয়া যায় না। আপনার খামারে যদি ১০০০ ডিম পাড়া মুরগি থাকে তাহলে ঐ মুরগি থেকে সবোর্চ্চ উৎপাদনকালীন সময়ে বা ২২ সপ্তাহ বা ২৫ সপ্তাহ বা ৫০ সপ্তাহ বয়সে যে পরিমান ডিম পাওয়ার কথা তা যদি না পাওয়া যায় তাহলে ধরে নিতে হবে কোথাও কোন সমস্যা রয়েছে। একজন খামারীকে সফল হতে হলে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা থকেতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব কারণে কোন খামারে ডিম উৎপাদন কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে তাহলো-মুরগির বয়স,জাত,পুষ্টি,পীড়ন,দিনের দৈর্ঘ্য ইত্যাদি। একটি মুরগি দিনে একটিই ডিম পাড়বে। ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি বা বাড়ানোর কৌশল মানে একটি মুরগি থেকে দিনে একটির বেশি ডিম পাওয়া নয়। ডিম পাড়া শুরু করলে সপ্তাহে এক বা দুদিন ডিম পাড়া বন্ধ থাকে। এ কারনে উৎপাদন কম হয়। যে বিষয়ে উপর গুরুত্ব দিতে হবে তাহলো মুরগি ও ডিমের অনুপাত কমিয়ে রাখা। অর্থাৎ যখন মুরগি থেকে কাঙ্খিত পরিমান ডিম পাওয়া যাবে না তখন যে বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রথমেই অনুসন্ধান করতে হবে তাহলো-
আলোঃ আমরা জানি মুরগির যৌনপরিপক্কতায় আসা এবং ডিম উৎপাদনের উপর আলোর প্রভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত যখন দিনের দৈর্ঘ্য বেশি থাকে তখন মুরগি ডিম বেশি পাড়ে। ডিমপাড়া মুরগির জন্য দৈনিক ১৪ ঘন্টার বেশি দিনের আলো দরকার। শীতকালে মুরগির ডিম উৎপাদন কমে যাওয়ার একটি অন্যতম কারন হলো দিনের দৈর্ঘ্য কম হওয়া। তবে আধুনিক বাণিজ্যিক মুরগি খামারে কৃত্রিম আলো প্রদানের মাধ্যমে মুরগির ডিমপাড়ার জন্য আলোক ঘন্টা তৈরি করা হয়। বাণিজ্যিক লেয়ার মুরগির খামারে একজন অভিজ্ঞ ও সচেতন খামারী মুরগির ঘরে কৃত্রিম আলোক ঘন্টা তৈরি করে ডিম উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে পারেন। আমাদের backyard পোল্ট্রির ক্ষেত্রে বিষয়টি খুব সহজে চোখে পড়ে কারন কোন আলোক কর্মসূচী থাকে না বিধায় শীতের শুরু থেকে বিশেষ করে অক্টোবর-নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত ডিমপাড়া কমে যায় এবং এরপর থেকে আবার ডিমপাড়া শুরু করে। বাণিজ্যিক খামারে মুরগির ডিম উৎপাদনের হার কমে গেলে বা নিদিষ্ট সময়ের আগে বা পরে ডিম পাড়া শুরু করলে মুরগি পালনকারী/খামারীকে এই সাধারণ বিষয়টি সম্পর্কে ধারনা থাকতে হবে। মুরগিকে বলা হয় long-season breeders কারন যখন দিনের দৈর্ঘ্য বেশি থাকে তখন উৎপাদনে আসে। পুলেট যখন ডিমপাড়া শুরু করে তখন আস্তে আস্তে আলোক ঘন্টা বাড়াতে হবে। সারা বছর ধরে ডিম উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে আলোক প্রদান কর্মসূচী প্রণয়ন করতে হবে।
পীড়ন ঃ পীড়নের কারনে মুরগির ডিমপাড়া কমে যায় এমন কি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যে সব কারনে মুরগিতে পীড়ন বা ধকল সৃষ্টি হয় তা হলো ঃ-
১) যদি ডিমপাড়া মুরগির শেডের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা খুব বেশি বা কম হয়
২) High stocking density, যদি শেডে মুরগির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য পাত্র , পানি পাত্র সরবরাহ নিশ্চত করা না হয়
৩) পরিবেশের উচ্চতাপমাত্রা বা Heat stress অথবা পরিবশে প্রতিকুল হলে
৪) ভ্যাক্সিনেশন, ঠোটকাটা বা ট্রিমিং, পরিবহন জনিত সময়ে পীড়ন সৃষ্টি হয়
৫) খাদ্যের গুনগত মানের সমস্যা হলে,খাদ্যে টক্সিন এর উপস্থিতি
৬) মুরগি হ্যান্ডলিং এর সময়
৭) ভেনিাটলেশন ব্যবস্থা ভালো না হলে
৮) ব্যবহৃত লিটারের গুনগতমান ভালো না হলে
৯) ক্লিনিক্যাল,সাবক্লিনিক্যাল বিভিন্ন রোগের কারনে মুরগিতে পীড়ন বা ধকল সৃষ্টি হয়
১০) সরবরাহকৃত পানির গুনগতমান ভালো না হলে বা পানি দূষিত হলে পানি গ্রহণ কমে যায় এবং পানিবাহিত রোগ সংক্রমন ঘটে এটাও একধরনের পীড়ন
১১) মুরগির ঘরে আলোর তীব্রতাও পীড়নের কারন। মুরগির ঘরে এ ধরনের ঘটনার উদ্ভব হলে তাৎক্ষণিক কার্যকর ব্যবস্থা করে মুরগির উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়।
খাদ্য ও পুষ্টি ঃ যে সব কারনে মুরগির উৎপাদনশীলতা ব্যহত হয় বা ডিম উৎপাদন কমে যায় খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারন। একটি মুরগি ডিমপাড়া অবস্থায় ১১০ -১২০ গ্রাম খাদ্য গ্রহন করে। সূষম খাদ্য ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি মুরগির ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং স্বাভাবিক রাখে এর মধ্যে প্রোটিন,এনার্জি এবং ক্যালসিয়াম অন্যতম। ডিমপাড়া মুরগির খাদ্যে ক্যালসিয়াম ঘাটতি হলে ডিম উৎপাদন কমে যায় এবং ডিমের খোসার গুণগতমান খারাপ হয়। ঝিনুকচূর্ণ এবং লাইমষ্টোন মুরগির খাদ্যে ক্যালসিয়ামের আলাদা উৎস। ডিমপাড়া মুরগির জন্য ৩.০ হতে ৩.৫ ভাগ ক্যালসিয়াম দরকার হয়। তবে বাড়ন্ত অবস্থায় যদি খাদ্যে বেশি ক্যালসিয়ামের মাত্রা বেশি হলে মুরগির কিডনি বিকল হতে পারে। খাদ্য ও পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হলে ডিম উৎপাদন কমে যেতে পারে। যে সব মুরগি খাচায় পালন করা হয় তাদের Cage-layer fatigue নামে এক ধরনের রোগ হয়। খাঁচায় পালন করা মুরগির শারিরীক movement বা চলাচল কম হয় এবং খাদ্যে ক্যালসিয়াম,ফসফরাস এবং ভিটামিন ডি এর পরিমান যথাযথ না হলে এটা হয়ে থাকে। ডিমপাড়া অবস্থায় খাদ্যে যথাযথ পরিমান ক্যালসিয়াম,ফসফরাস এবং ভিটামিন ডি এর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। ৪০ সপ্তাহ বয়সের উপরের লেয়ার মুরগির উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদার একটি তালিকা নিম্নে তুলে ধরা হলো।
বিপাকীয়শক্তি আমিষ চর্বি আঁশ
কিঃক্যাঃ % % % %
২৮৬০ ১৫ ৩.২৯ ৩.০ ৩.৫
জায়গা ঃ মুরগির সঠিকভাবে ডিম উৎপাদনের জন্য যথাযথ পরিমান জায়গা বরাদ্ধ করতে হবে। তবে একটি মুরগির জন্য কি পরিমান জায়গা দরকার হবে তা কিছুটা মুরগির আকার, জাত, কি পদ্ধতিতে পালন করা হবে তার উপর নির্ভর করে। মাচা বা লিটার পদ্ধতিতে পালন করলে একটি ডিমপাড়া মুরগির জন্য ১.৫ থেকে ২.০ বর্গফুট জায়গা দরকার হবে। যে পদ্ধতিতেই পালন করা হোক না কেন যদি মুরগি ডিমপাড়া অবস্থায় পর্যাপ্ত জায়গা না দেয়া হয় তাহলে ডিম উৎপাদন কমে যাবে। তাই মুরগির উৎপাদন বাড়াতে হলে এ বিষয়টি উপরও নজর দিতে হবে।
বয়স ঃ মুরগির বয়স ডিম উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। বাণিজ্যিক লেয়ার মুরগি সাধারণত ১৮-২০ সপ্তাহ বয়সে ডিমপাড়া শুরু করে এবং ২৪-২৬ সপ্তাহ বয়সে সবোর্চ্চ উৎপাদন হয়। ডিম উৎপাদন সবোর্চ্চ পর্যায়ে পৌছার পর আস্তে আস্তে কমতে থাকে এবং ৭২ সপ্তাহ বয়সের পর ৭০% এ নেমে আসতে পারে। মুরগির বয়সের সাথে ডিম উৎপাদনের যে একটি সহস্বন্ধ বিরাজিত তা না জেনে খাদ্য পুষ্টি সরবরাহ করলেই উৎপাদন বাড়বে না।
জাত ঃ বর্তমান সময়ে মুরগির অধিক উৎপাদনশীল বিভিন্ন ধরনের ষ্ট্রেইন বা বাণিজ্যিক জাত পালন করা হয়। বিভিন্ন ব্রিডার্স কোম্পানী ভিন্ন ভিন্ন জাত বা ষ্ট্রেইনের মুরগির কৌলিতাত্তিক উন্নয়ন( উৎপাদন কাল বৃদ্ধি,খাদ্য রুপান্তর হার ইত্যাদি)ঘটিয়ে বাচ্চা বাজারজাত করে থাকে এবং প্রত্যেকটির জন্য উৎপাদন ও ম্যানেজমেন্ট ম্যানুয়্যাল তৈরি করেন যাতে ঐ জাতের বা ষ্ট্রেইনের মুরগি সম্পর্কে বিবরণ থাকে। তাই উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে একজন খামারী যে জাতের মুরগি পালন করবেন সে জাতের মুরগির পারফরমেন্স সম্পর্কে ধারনা থাকতে হবে।
পুলেট ম্যানেজমেন্ট ঃ আপনার খামারের মুরগি ডিম উৎপাদন কেমন হবে তা পুলেট ম্যানেজমেন্টর উপর অনেকাংশ নির্ভর করে। যদি পুলেটের পুষ্টি এবং আলোক ব্যবস্থাপনা ভালো না হয় তাহলে তা ভবিষ্যৎ উৎপাদনের উপর প্রভাব ফেলবে। যদি পুলেট কাঙ্খিত বয়সের আগেই উৎপাদনে আসে তাহলে ডিমের আকার ছোট হবে এবং স্বাস্থ্যগত ( prolapse) সমস্যার সৃষ্টি হবে। এবং সারা বছর ধরে ছোট আকারের ও কম ডিম পাড়বে।
ডিমপাড়ার বাক্সঃ যদি মুরগি লিটার পদ্ধতিতে বা মাচায় পালন করা হয় তাহলে ডিম উৎপাদন ভালো পেতে অবশ্যই ডিম পাড়ার বাক্স দিতে হবে। বাক্স না দিলে ডিম উৎপাদন কম হবে। সাধারণতঃ ৩০ সেমি X ৩০ সেমি আয়তনের একটি বাক্স ৫ টি মুরগির জন্য সরবরাহ করতে হবে।
মল্টিং ঃ প্রতি বছর মুরগির শরীরের পুরাতন পালক খসে পড়ে নতুন পালক গজায় এই অবস্থা বা পালক পড়ার প্রক্রিয়াকে মোল্টিং বলা হয়। মোল্টিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত ডিম উৎপাদন কমে যায়। মোল্টং দুই ধরনের হয়ে থাকে Late molting এবং Early molting| Late molting মুরগি ১২-১৪ মাস ডিম পাড়ার পর হয়ে থাকে এবং অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়। কিন্তু “early molting মুরগি ডিম পাড়া শুরু করার অল্প সময়ের মধ্যে শুরু হয়ে শেষ হতে ৬ মাস পর্যন্ত সময় লাগে। মোল্টিং এর সময় মুরগির দৈহিক ওজন ২৫ ভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এ সময় ডিম উৎপাদন কমে যায়।
কালিং ঃ মুরগির ডিম উৎপাদন বাড়ানো এবং উৎপাদন খরচ কমানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুরগির কালিং বা বাতিল করা। এই কালিং মুরগির ব্রুডিং অবস্থা থেকে শুরু করে ডিমপাড়ার শেষ সময় পর্যন্ত চলতে পারে। কালিং হলো মুরগির ফ্লকের অনুৎপাদনশীল মুরগি বের করে দেয়া। বিভিন্ন সময়ে কালিং করা যেতে পারে তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো উৎপাদনের সময়। মনে করুন আপনার খামারে ১০০০ টি মুরগি আছে এর মধ্যে অনেক মুরগি আছে যেগুলো বেশ কিছু থেকে ডিম পাড়ছে না বলে ডিম উৎপাদন কম হচ্ছে কিন্তু খাদ্য খরচ কমছে না। এই ডিম না পাড়া মুরগিগুলোকে খামার থেকে বের করে দিলে ডিম উৎপাদনের হার বেড়ে যাবে। কি ভাবে বাড়বে? যদি ১০০০ মুরগি থেকে প্রতিদিন ৯০০ ডিম পাওয়া যায় তাহলে উৎপাদন পারফরমেন্স হবে ৯০%। কিন্তু এর মধ্যে থেকে যদি দীর্ঘ সময় ধরে ডিম না পাড়া ৫০টি মুরগি বের করে দিই তাহলে মোট মুরগির সংখ্যা হচ্ছে ৯৫০ এবং ডিম পাওয়া যাচ্ছে ঐ ৯০০ টিই অর্থাৎ উৎপাদন পারফরমেন্স হবে ৯৫%। কিভাবে অনুৎপাদনশীল মুরগি সনাক্ত করা হবে এটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারনতঃ দুইভাবে এটা করা যায়। মুরগির বাহ্যিক অবস্থা বা চেহারা দেখে এবং কিলবোন ও পিউবিকবোনের (pubic bone) মধ্যে দুরত্ব দেখে। ডিম না পাড়া মুরগির কানের লতি,মাথার ঝুটি ফ্যাকাসে হবে এবং কিলবোন হতে কিলবোনের মধ্যে দুরত্ব দুই আঙুলের কম হবে এবং কিলবোন ও পিউবিকবোনের মধ্যে দুরত্ব হবে ৪ আঙুলের কম।
এছাড়া মুরগি যদি কোন কারনে বিরক্ত হয় (উচ্চ শব্দ,অকারণে বার বার মুরগির ঘরে প্রবেশ ইত্যাদি) বা ভয় পায় তাহলে ডিম উৎপাদন হঠাৎ বন্ধ বা কমে যেতে পারে। বিভিন্ন রোগের কারেনেও ডিম উৎপাদন কমে যায় তবে এ বিষয় সম্পর্কে আমার তাৎক্ষণিক বুঝতে পারি এবং ব্যবস্থা নিতে পারি। তাই রোগের চেয়ে উল্লেখিত বিষয়সমুহ অধিক গুরুত্বপূর্ণ কারন এই বিষয়গুলো আমারা সহজে বুঝতে পারি না। অনুসন্ধান করে বের করে তারপর ব্যবস্থা নিতে হয়।
লেখকঃ মোঃ মহির উদ্দীন
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, ঈশ্বরদী, পাবনা
Sent by Md.Arafath Hossain (Barisal)