দিনের পর দিন বেড়েই চলছে হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবারের দাম। এতে লোকসান গুণতে হচ্ছে পোল্ট্রি এবং মৎস্য খামারিদের। তাই অনেকেই এখন হাঁস-মুরগি, মাছের খাবারের বিকল্প খাদ্য হিসেবে ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ বা কালো মাছি চাষ করছেন। চাঁদপুরের কয়েকজন উদ্যোক্তা জানিয়েছেন সম্ভাবনাময় এই কালো মাছি চাষ করে বেশ লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এটি চাষ করে মাছ, হাঁস-মুরগির খাবারের চাহিদাও অনেকাংশ মেটানো সম্ভব।
জানা যায়, পরীক্ষামূলকভাবে চাঁদপুর শহরের কোড়ালিয়া এলাকায় অভিযাত্রা নামে একটি আত্মপ্রত্যয়ী সমাজ সেবা সংগঠন এই কালো মাছি চাষের উদ্যোগ নেয়। ওই সংগঠনের কর্মকর্তারা ও হাইমচর উপজেলার উত্তর আলগী এলাকার প্রবাসী সুমন পাটওয়ারী ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। এছাড়াও ফরিদগঞ্জের রূপসা উত্তর ইউনিয়নের দক্ষিণ গাব্দেরগাঁও গ্রামের প্রবাস ফেরত শফিকুর রহমান ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ চাষ করছেন।
অভিযাত্রা নামে সংগঠনের সভাপতি জাকির মিয়াজী জানান, আমরা করোনাকালীন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে একটি সংগঠন গঠন করি। এই সংগঠনটি ২০ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি। এর মাধ্যমে মাছ-মুরগি পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মাছ-মুরগির খাবারের জন্য ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ বা কালো মাছি চাষ করছি। এই মাছির লার্ভা মাছ, মুরগি খেতে পছন্দ করে। এ খাবার খেয়ে মাছ, মুরগির শারীরিক কোনো সমস্যাও হয় না।
সংগঠনের পরিচালক ও ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ের উদ্যোক্তা সোহেল পাটওয়ারী জানান, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই হচ্ছে এমন একটা পোকা যা দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। বাজার থেকে ক্রয়কৃত ক্ষতিকারক ‘ফিড’ মাছ, মুরগিকে খাওয়ানো হয়। সেই মাছ, মুরগি মানুষ খেয়ে থাকে। কিন্তু এগুলো মানুষের শরীরের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর। কালো মাছির লার্ভা যে সকল মাছ মুরগিকে খাওয়ানো হয়, সেসব মাছ-মুরগি খেলে মানুষের শরীরের ক্ষতি হবে না। বর্তমানে বাজারে মাছ, মুরগীর খাবারের দাম বৃদ্ধির কারণে উদ্যেক্তারা খামার করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তাদের দিনের পর দিন লোকসান হচ্ছে। তাই ফিডের বিকল্পে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই খুঁজে বের করি। এটি উৎপাদনে খরচ খুবই কম। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ের খাবারের জন্য আলাদা খাবার কিনতে হয় না। অর্থাৎ উচ্ছিষ্ট খাবার, যেমন- বাজারের পচা কাঁচা শাক-সবজি, ফলমূল অথবা হোটেল মোটেলের উচ্ছিষ্ট পচনশীল খাবার, বিয়ে বাড়িতে ফেলে দেওয়া খাবার, মাছ কাটার উচ্ছিষ্ট অংশ ও মুরগির ভুড়ি ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই-এর লার্ভার খাবার হিসেবে ব্যবহার হয়। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই চাষের মাধ্যমে আমরা দুটি ভালো কাজ করতে পারছি। একটা হলো হাঁস-মুরগির খাদ্য উৎপাদন করছি। আরেকটি সমাজকে উচ্ছিষ্ট মুক্ত রাখতে পারছি।
তিনি আরও বলেন, এক বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে এটার চাষ শুরু করে গত দুই মাস আগে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করি। এক চালানে আড়াই হাজার মুরগিকে প্রায় ৯শ ৪ কেজি লার্ভা খাওয়াই। এতে ৯শ ৪ কেজি ফিড সেইফ হয়। বাজার থেকে ৯শ ৪ কেজি ফিড ক্রয় করলে আমাদের খরচ হত ৬১ হাজার তিনশ ৬০ টাকা। আগামীতে আমরা আরও বেশি মুরগি উৎপাদন করব। আমাদের টার্গেট হচ্ছে আগামী সেশনে প্রায় ৪ টন লার্ভা খাওয়াব। কিছুদিন আগে বাজারে হঠাৎ করে মুরগির দাম কমে গেলে এতে খামারিদের লোকসান গুণতে হয়। কিন্তু ওই সময়ে আমাদের লোকসান হয়নি। মুরগিকে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ের লার্ভা খাওয়ানোর কারণে আমাদের লাভ হয়। আমাদের আশেপাশে অনেক খামারির লোকসান হয়েছে কারণ তারা বাজারের ক্রয় করা ফিড মুরগিকে খাইয়েছে। আমরা ভবিষ্যতে লার্ভা দিয়ে ফিড উৎপাদন করব।
সংগঠনের কর্মচারী আনোয়ার হোসেন মিজি জানান, এই সংগঠনের মাধ্যমে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ের লার্ভা দিয়ে মাছ, মুরগির খাবার তৈরি করা হয়। আমরা পাচঁজন বেকার অবস্থায় ছিলাম। তারা আমাদের চাকরি দেয়। এখানে এই লার্ভা মাছ, মুরগি, হাঁসকে খাওয়াচ্ছি। এই খাবার তৈরি করতে গড় খরচ হয় ২০ থেকে ২২ টাকা। আর বাজারে মাছ-মুরগির খাবার প্রতি কেজি ফিড প্রায় ৬৫ টাকা দরে খামারিরা এটা কিনে তেমন একটা লাভ করতে পারে না।
হাইচরের সৌদি আরব প্রবাসী সুমন পাটওয়ারী জানান, আমি একজন প্রবাসী। আমি ইউটিউবে কিছু দিন ঘাটাঘটি করলে আমার চোখে পড়ে কালো মাছি চাষ। ইউটিউব দেখে এর সর্ম্পকে ধারণা নিলাম। আমি একটি মুরগির খামার তৈরি করি। মুরগীর পোল্ট্রি খাবারের পাশাপাশি বিকল্প খাবারের জন্য ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ বা কালো মাছি চাষ শুরু করি। গত ১ বছর ধরে সফলতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছি।
সুমন পাটওয়ারী খামারে দায়িত্বরত তার চাচাতো ভাই কাদির পাটওয়ারী জানান, ব্ল্যাক সোল্ডার প্লাই বা কালো মাছির ডিম হাঁস মুরগি মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমার চাচাতো ভাই প্রবাসী সুমন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বরিশাল থেকে কালো মাছি ক্রয় করে আনিয়েছে। প্রথমে লাভকেছে এই মাছির পোকা ঢোকানো হয়। সেখান থেকে মাছি বের হয়। এদের খাদ্য হিসেবে পানি দেওয়া হয়। তাদেরকে তিন বেলা পানি দেওয়া হয়। লাভকেছের ভেতরে কাঠের টুকরো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কাঠের ভেতরে ফাঁকা অংশে তারা ডিম পাড়ে। ডিমের খাবার হিসেবে ভুট্টার গুঁড়া দেওয়া হয়। এছাড়াও খোল দিয়ে এর ওপর মশারি টাঙিয়ে দেওয়া হয়। ডিমগুলো তিন থেকে চার দিন পরে ফোটে। ডিম ফোটার পর বড় একটি পাত্রে পোকাগুলো ঢেলে দেওয়া হয়। পাত্রে ঢালার পরে খাবার হিসেবে পচনশীল জৈব পদার্থ, সবজির উচ্ছিষ্ট, পচা ফলমূল, হোটেল-মোটেলের অব্যবহৃত উচ্ছিষ্ট পচনশীল সবকিছুই এই পোকার লার্ভা খেয়ে থাকে। এই পোকার লার্ভা ১৩ থেকে ১৪ দিন পরে মাছ-মুরগি, হাঁসের খাবারে উপযোগী হয়। বর্তমানে আমরা লাভবান হচ্ছি।
ওই গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা আলামিন জানান, আমাদের এলাকায় কালো মাছির ডিম উৎপাদন করা হচ্ছে। এটা খুব লাভবান ব্যবসা । এগুলো হাসঁ, মুরগির পোল্ট্রির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্বল্প খরচের আর্থিক লাভবান হওয়ার এটা একটা প্রযুক্তি। উপজেলা মৎস্য, পশু ও প্রাণী সর্ম্পদ কমকর্তারা যদি বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কাজে উৎসাহ করেন। তাহলে এসব যুক্তির মাধ্যমে বেকার সমস্যা দূর হবে। সুমন পাটওয়ারীকে সাধুবাদ জানাই। তার কালো মাছির চাষ দেখে অনেকেই আগ্রহী হবে।
চাঁদপুর জেলা ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা মুরাদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে জানান, ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ নতুন প্রযুক্তি। এটি হাঁস-মুরগির খাবার এবং জৈব সার হিসেবে উৎপন্ন করা হয়। এই মাছির জীবনকাল চারটি পর্যায়ে। এটা যখন লার্ভা থাকে তখন এটাকে যে খাবার দেওয়া হয়, পরে সেটা মলত্যাগ করে। সেটার থেকে খুব ভালো জৈব সার তৈরি হয়। পচনশীল জৈব পদার্থ যেমন সবজির উচ্ছিষ্ট, পচা ফলমূল মূলত উচ্ছিষ্ট পচনশীল সবকিছুই এই লার্ভা খেয়ে থাকে। আমরা এই মাছিকে এক টন খাবার দেই তাহলে প্রায় আড়াই শ কেজি লার্ভা উৎপাদন হবে। এতে প্রায় ১শ কেজি জৈব সার উৎপাদন হবে। এই লার্ভা মাছ-মুরগী, হাঁসের অত্যন্ত প্রিয় খাবার। এর থেকে যেই জৈব সার উৎপাদন হয় সেটি অনেক উন্নত মানের। এটি জমিতে ব্যবহার করা যায়।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মেহেদী হাসান ঢাকা পোস্টকে জানান, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই চাঁদপুর সদর, ফরিদগঞ্জ, হাইমচরে মাছের খাবার হিসেবে ইদানিং ব্যবহৃত হচ্ছে। কালো মাছির লার্ভা প্রাণিজ আমিষ। মাছ চাষ করতে গেলে মাছের খাবারে আমিষের বেশি প্রয়োজন হয়। বাজারের মাছের খাদ্যের দাম বর্তমানে বেশি। তাই পোল্ট্রির খাবারের পাশাপাশি চাষিরা এটি মাছ চাষে ব্যবহার করছে। এতে করে মাছের খাদ্যে ঘাটতি কমে আসবে। এটি মাছ চাষিরা ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করলে আর্থিকভাবে লাভবান হবে। এতে মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে।
চাঁদপুর সরকারি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক শওকত ইকবাল ফারুকী ঢাকা পোস্টকে জানান, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই এক ধরণের মাছি। মূলত এটির ডিম থেকে লার্ভা হয়। এই লার্ভা মাছ বা মৎস্য জাতীয় যে সকল জলজ প্রাণী আছে তাদের জন্য এটি খুব উৎকৃষ্ট প্রাণিজ প্রোটিন খাবার হিসেবে কাজ করে। এই লার্ভাগুলো অতি অল্প সময়ে খুব দ্রুত বর্ধনশীল। যার ফলে কৃষক, পোল্ট্রি এবং মৎস্য খামারিরা এই মাছিকে বিকল্প খাবার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। এদের উৎপাদন খরচ অনেক কম।
তিনি আরও বলেন, এই মাছিকে গৃহে প্রতিপালন করলে খরচ হবে অনেক কম। এদের খাবার হচ্ছে গৃহস্থালীর বর্জ্য। আমাদের প্রতিদিনকার খাবারের বর্জ্য খেয়ে মাছির লার্ভাগুলো বড় হয়। সুতরাং আমরা অল্প পরিশ্রমে এবং বিনা খরচে এ লার্ভাগুলো প্রতিপালন ও উৎপাদন করতে পারি। মাছ ও মুরগির খামারগুলোতে ফিড হিসেবে ব্যবহার করলে মাছ মুরগির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি মাছ ও মুরগির স্বাদ ও গুণগত মান ভালো থাকবে। আমি আশা করছি কৃষক ও মৎস্যজীবীরা এই মাছি চাষ করলে লাভবান হবেন। এতে পরিবেশে দূষিত পদার্থগুলোকে তারা খাবার হিসেবে গ্রহণ করলে পরিবেশও পরিষ্কার থাকবে।
Copy from: Dhaka post