ময়ূর শুধু চিড়িয়াখানাতেই দেখা যায় এমন না। আজকাল দেশে মানুষ ময়ূরের বাণিজ্যিক খামারও করছে। দেশে নতুন নতুন পয়সাওয়ালা মানুষ তৈরি হচ্ছে। তারা সৌখিন হয়ে উঠছে। এই নব্য সৌখিন লোকেরাই এখন ময়ূরের বড় ক্রেতা। ফলে বুঝতেই পারছেন, কতোটা সম্ভাবনাময় ময়ূরের বাণিজ্যিক খামার!

কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শাহ আলী শখ করে এক জোড়া ময়ূর কিনে এখন বিশাল খামার বানিয়েছেন। এখন তাঁর খামারে রয়েছে শতাধিক ময়ূর। ময়ূর বিক্রি করে নিজের ও পরিবারের সচ্ছলতা এনেছেন।
হোমনার উপজেলার বাবরকান্দি এলাকায় শাহ আলীর ময়ূরের খামার। তাঁরা বাবা গরুর খামার করেছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি ময়ূর পালন শুরু করেছেন।
২০১৯ সালের শেষ দিকে নিজের জমানো ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে এক জোড়া ময়ূর কিনে আনেন। বেশ কয়েক মাস পর সেগুলো ডিম দেওয়া শুরু করে। প্রথমে ২৪টি ডিম দেয়। সেখান থেকে ১৭টির বাচ্চা হয়। এগুলো লালন-পালনের জন্য ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি শেড নির্মাণ করেন।
২০২০ সালের শেষ দিকে এসে ময়ূর বিক্রি শুরু করেন শাহ আলী। শৌখিন মানুষজন এগুলো কিনে পালন করেন। এক জোড়া ময়ূর ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন।
২০২০-২১ সালে ২০ লাখ টাকার ময়ূর বিক্রি করেছেন। এতে তাঁর লাভ হয়েছে ১০ লাখ টাকা।
ময়ূর লালন-পালন খুবই সহজ। নিচে ময়ূর পালন ও পরিচর্যার বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো :
১.১. ছানাগুলোকে গরমে রাখুন: 
খেয়াল রাখতে হবে ছানাগুলোর যেন ঠান্ডা না লাগে, ময়ুর ছানাকে সর্বদা উষ্ণতার মধ্যে রাখতে হয়, বাচ্চার বয়স ৪ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটে রাখতে হবে। আমাদের দেশে শীতকালে  ঘরের মধ্যে লাইট দিয়ে পরিবেশ গরম করে বাচ্চাগুলোকে একত্রে জড়ো করে , বাচ্চাদের দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখতে হবে তারা শীত অনুভব করছে কি না, সেই অনুযায়ী তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, শীত শেষ হয়ে এলে আবার স্বাভাবিকভাবে পালতে হবে।
১.২. বড় খাঁচা নির্মাণ
খোলা স্থানে ময়ূর পাললে এগুলো উড়ে যাবে, আবার ছোট খাঁচা হলে এরা চলাচল করতে পারবে না। তাই ময়ূর পালনের জন্য অবশ্যই অতিকায় আকারের খাঁচা নির্মাণ করতে হবে, কেননা এদের কিছুটা ওড়ার সুযোগ দিতে হবে।
খাঁচার উচ্চতা কমপক্ষে ৮ ফুট হওয়া উচিৎ। খাঁচা খিলান আকৃতির হলে ভালো। ময়ূর শূন্যে থেকে কিছুটা উপরে বিশ্রাম নেয়, তাই ৫-৬ ফুট উঁচু মাচাং কিংবা গাছের ডাল দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, যখন ময়ূর পেখম মেলে  তখন তার জন্য প্রায় ৭-৮ ফুট জায়গা লাগে। তাই খাঁচার প্রস্থ ৯-১০ ফুট হওয়া চাই। তাতে ময়ূর থাকবে সুস্থ সুন্দর।
১.৩. কাঠের তৈরি খোয়াড়
খাঁচার এক প্রান্তে থাকবে খোয়াড় যা কিনা রোদ, বৃষ্টি, ঠান্ডা থেকে রক্ষা করবে। কাঠ দিয়ে তৈরি খোয়াড় ময়ূরের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত। খোয়াড়টি হতে হবে পরিষ্কার, শুষ্ক এবং জীবাণুমুক্ত। ময়ূরগুলো ডিমে তা দেওয়া, ছানাগুলোর আরাম ও উষ্ণতার জন্য খোয়াড়ে দিতে হবে খড়। বিড়াল কিংবা অন্য কোনো শিকারী প্রাণী থেকে সবসময়  নিরাপদ থাকে।
১.৪. স্থানের সাপেক্ষে ময়ূরের ঘনত্ব
মুরগির মতো ময়ূরকে ঘিঞ্জি পরিবেশে রাখবেন না, তাতে ময়ূরের স্বাস্থ্য নষ্ট হয় এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেড়ে যায়। পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো-বাতাস থাকলেই ময়ূরের বৃদ্ধি দ্রূত হয়।
২.১. ময়ূরের খাদ্যাভ্যাস 
ময়ূরের খাঁচায় খাদ্যে এবং পানির পাত্র আলাদা করে দিন। খাদ্যের পাত্র চেইন দিয়ে সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে দিলে ভালো। তাতে ইঁদুর, তেলাপোকা ও ময়লা থেকে খাদ্যে সংরক্ষিত থাকবে। পানির পাত্রও মাটি থেকে উপরে রাখুন যেন তা সহজে নোংরা না হয়। পানির পাত্রে ১০ থেকে ১৫ লিটার পানি রাখবেন।
ময়ূরের বাচ্চার বয়স বাড়ার সাথে তার খাদ্যের মিশ্রণের অনুপাত পরিবর্তন করতে হয়। বাচ্চার বয়স ৬ সপ্তাহ হওয়া পর্যন্ত ধীরে ধীরে প্রোটিনের মাত্রা কমিয়ে পূর্ণবয়স্ক ময়ূরের খাদ্যে অভ্যস্ত করাতে হয়।
নিচে ময়ূরের বাচ্চার প্রথম ৭ সপ্তাহের খাদ্যের তালিকা দেখানো হলো:
১ম সপ্তাহ: ৩ ভাগ মিশ্রিত খাদ্যে এবং ১ ভাগ  পূর্ণবয়স্কের খাদ্যে
২য় সপ্তাহ: ২.৫ ভাগ মিশ্রিত খাদ্যে এবং ১ ভাগ  পূর্ণবয়স্কের খাদ্যে
৩য় সপ্তাহ: ২ ভাগ মিশ্রিত খাদ্যে এবং ১ ভাগ  পূর্ণবয়স্কের খাদ্যে
৪র্থ সপ্তাহ: ১.৫ ভাগ মিশ্রিত খাদ্যে এবং ১ ভাগ  পূর্ণবয়স্কের খাদ্যে
৫ম সপ্তাহ: ১ ভাগ মিশ্রিত খাদ্যে এবং ১ ভাগ  পূর্ণবয়স্কের খাদ্যে
৬ষ্ঠ সপ্তাহ: ০.৫ ভাগ মিশ্রিত খাদ্যে এবং ১ ভাগ  পূর্ণবয়স্কের খাদ্যে
৭ম সপ্তাহ: সম্পূর্ণ পূর্ণবয়স্কের খাদ্য
আবদ্ধ অবস্থায় লালন-পালনের ক্ষেত্রে এদেরকে নিয়মিত গম, ধান, সবজি, শস্যবীজ ইত্যাদি খেতে দিতে হয়। পেঁপে, তরমুজসহ অন্যান্য পাকা ফলও এদের প্রিয় খাদ্য।
দৈনিক খাদ্য তালিকা (মাথাপিছু)
শস্যদানা- ১৫০ গ্রাম
টুকরা শাকসবজি- ১০০ গ্রাম
ভাত- ৩০০ গ্রাম
সেই সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।
২.২.  ময়ূরকে মাঝে মাঝে স্পেশাল ট্রিট ও স্বাস্থ্যে সেবা দিন
বেশি ঠোঁকরাঠুকরি কিংবা ঘেঁষাঘেষি করলে ময়ূরের স্বাস্থ্য খারাপ হয়। তাই তাদের মাঝে মাঝে স্পেশাল কেয়ার করুন। যেমন: মাঝেমাঝে সুস্বাদু ফলমূল, শাকসবজি, মাংস, পাউরুটি, মেডিকেল চেকআপ, ওষুধ খাওয়ানো ইত্যাদি। ময়ূরকে ছোট হাড় কিংবা মাছের কাঁটা দিবেন না, এগুলো গলায় বিঁধে যেতে পারে।
৩. স্বাস্থ্য
ময়ুরকে সুস্থ রাখতে নিয়মিত এদের  স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন। ময়ুরকে উকুনমুক্ত রাখতে বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মুরগির উকুননাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলে আর পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পেলে ময়ূরের সাধারণত রোগবালাই হয় না।