কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় প্রাণিসম্পদের অবদান অনস্বীকার্য। সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সংরক্ষণ, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও জাত উন্নয়নে রয়েছে অভাবনীয় সাফল্য। প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নানা উপাত্তনির্ভর। এগুলো হলো গবাদি প্রাণি স্বাস্থ্য সেবা, প্রাণী-সহায়ক কার্যক্রম, প্রাণী সম্বন্ধীয় বিলি ব্যবস্থা, মানসম্পন্ন উৎপাদনের বিস্তরণ, প্রাণিসম্প্রসারণ সেবা এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে অধিকতর সহযোগিতা। প্রাণীর বিবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা, রোগ নিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ মোকাবিলা ইত্যাদি প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি প্রধান দিক।
এগুলো ছাড়াও আরও কিছু অপরিহার্য দিকও রয়েছে, যেমন জাত উন্নয়নের মাধ্যমে প্রাণীর শ্রীবৃদ্ধি, কৃত্রিম প্রজনন, প্রযুক্তি হস্তান্তর ইত্যাদি। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত খাতসহ বাংলাদেশে নানা সংস্থা প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। করোনাসহ সব দুর্যোগ কিংবা মহামারিতে বাংলাদেশের মূল শক্তি ও আশার জায়গা কৃষি; যা কৃষি, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য এই তিনটি খাতকে নিয়ে গঠিত। এ সফলতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে, কেননা তিনিই কৃষিবিদদের ক্লাস ওয়ানের সম্মান এবং কৃষি শিক্ষা ও গবেষণাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দুধ-ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার পথে, ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম, মাছ উৎপাদনে বিশ্বে রোল মডেল। কোন একটি সেক্টরের গুরুত্ব বুঝতে হলে জিডিপিতে তার অবদান কত এটিই মূল নির্ণায়ক। সত্য তথ্য যেমন একটি সেক্টরের গুরুত্ব বোঝাতে সহায়তা করে তেমনি পলিসি মেকারদের গুরুত্বপূর্ণ খাত সনাক্তকরণ ও ঠিক ঠাক সিদ্ধান্ত গ্রহনে সহায়তা করে।
মুজিব বর্ষের কর্মপরিকল্পনা, সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী কর্মপরিকল্পনা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনে প্রাণিজাত পণ্যের যথাযথ উৎপাদন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাজার ব্যবস্থার সংযোগ বাড়ানো, পণ্যের বহুমুখীকরণ, ফুড সেফটি নিশ্চিতকরণ এবং ক্যাটেল ইনসুরেন্স ব্যবস্থা প্রবর্তনে সরকারের নানামুখী উদ্যোগে প্রাণিসম্পদে খাতে অভাবনীয় অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ উপখাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৩.৮০ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৩.১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই সেক্টরের সাথে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২০ শতাংশ এবং পরোক্ষভাবে ৫০ শতাংশ মানুষ জড়িত।
দুধের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিতকল্পে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, মাননিয়ন্ত্রণ ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং দুধ পানের অভ্যাস গড়ে তোলায় সুদূর প্রসারী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ১১৯.৮৫ লক্ষ মেট্রিক টন, যা ২০১০-২০১১ অর্থবছরের তুলনায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পায়। এখন প্রতিদিন জনপ্রতি প্রাপ্যতা ১৯৩.৩৮মিলিতে উন্নীত হয়েছে। বিগত দশকে কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, জাত উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং ডেইরি স্টকের সংখ্যাগত উত্থান দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
সরকারের নীতিগত সহায়তার ফলে বাংলাদেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। গত এক দশকে মাংস উৎপাদন ৪.২৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮৪.৪০ লক্ষ মেট্টিক টনে উন্নীত হয়েছে এবং প্রতিদিন জনপ্রতি প্রাপ্যতা দাঁড়িয়েছে ১৩৬.১৮ গ্রাম। ২০২০-২১ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল ২০৫৭.৬৪ কোটি, যা ২০১০-২০১১ অর্থবছরের উৎপাদনের (৬০৭.৮৫ কোটি) তুলনায় ৩.৪ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে প্রতিদিন ডিমের জনপ্রতি প্রাপ্যতা ১২১.১৮ টিতে উন্নীত হয়েছে। গত এক দশকে প্রাণিজাত পণ্য উৎপাদনের ধারাবাহিকতায়, দেশ বর্তমানে মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে মাংসের চাহিদা শতভাগ পূরণ করে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
জাত উন্নয়ন ও কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমের অংশ হিসাবে ২০১০-১১ অর্থবছরে গবাদিপশুর সিমেন উৎপাদনের পরিমান ছিল ২৫.৮৪ লক্ষ ডোজ, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪.৪১ লক্ষ ডোজ। গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশব্যাপী ৪,৬৯৪ টি কৃত্রিম প্রজনন উপকেন্দ্র/পয়েন্ট এর মাধ্যমে ৪৩.৬৫ লক্ষ গাভীতে কৃত্রিমভাবে প্রজনন করা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশনে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতি দ্রুত মাঠ পর্যায় থেকে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের একটি সার্ভিলেন্স কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্রুত এ রোগ নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণের ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে।
প্রাণিসম্পদের চিকিৎসা উন্নয়নে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের ফলে, গবাদিপশুর কৃমিরোগ দমন, পিপিআর রোগের সমন্বিত চিকিৎসা, ELISA ভিত্তিক ক্ষুরারোগ নির্ণয়, পিপিআর ও রিন্ডারপেস্ট রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, বাণিজ্যিক খামারে মুরগির জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, পিপিআর ও সালমোনেলা ভ্যাকসিন উদ্ভাবন ও ব্যবহার ইত্যাদি সহজতর হয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে গবাদিপশুর রিন্ডারপেস্ট নামক ভাইরাসজনিত ভয়াবহ রোগের প্রকোপে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ২ লক্ষ গবাদিপশুর মৃত্যু হতো। এ অবস্থায় রোগটি নির্মূল করার লক্ষ্যে সারাদেশে গত কয়েক দশকে গবাদিপশুতে রিন্ডারপেস্ট টিকা প্রয়োগের ফলে ২০১০ সালে World Organization for Animal Health (OIE) কর্তৃক বাংলাদেশকে রিন্ডারপেস্ট মুক্ত ঘোষণা করে।
গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ০৯টি প্রুভেন বুল (Proven Bull) উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে প্রুভেন বুলে’র সিমেন দ্বারা কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, ফলে দেশে অধিক দুধ ও মাংস উৎপাদনশীল গাভীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত এক দশকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক মোট প্রায় ৯২ লক্ষ বেকার যুবক, যুব মহিলা, দুস্থ মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে গবাদীপশু ও হাঁস-মুরগী পালন বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে বর্তমান সরকারের ভিশন ২০৩০ ও ২০৪১ বাস্তবায়নে প্রানিসম্পদ খাত আরও আধুনিক ও উন্নত করতে হবে, জনবল বৃদ্ধি ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে হবে।
লেখক : প্রফেসর ড. মো. রাশেদুল ইসলাম
সূত্র: আরটিভি ।