বছর তিনেক আগে করোনা পরিস্থিতিতে মাছের দাম কমেছিল। তবে বর্তমানে যে দামে মাছ বিক্রি হচ্ছে তা ৫ বছরের সর্বনিন্ম দাম। মাছে লোকসান গুনছেন মাছচাষিরা। কেজিতে অন্তত ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা নাই হয়ে গেছে। রাজশাহীর মাছচাষিরাও ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। মাছের দামে উঠছেনা উৎপাদন খরচ। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে এলাকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি মৎস্য-চাষিরা। অনেক মাছচাষি নতুন পুকুর লিজ নিচ্ছেন না লোকসানের আশঙ্কায়।
রাজশাহী মাছচাষিরা জানান, বর্তমানে জমি লিজ ও মাছের খাবার হিসাব করে লোকসানের দিকে শতকরা ৯০ ভাগ চাষি। নিজস্ব জমিতে মাছ চাষ করেন না এখানকার চাষিরা। পুকুর লীজ নিয়ে মাছ চাষ করেন অধিকাংশ উদ্যোক্তা ও চাষি। করোনা গেলেও দফায় দফায় মাছে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়া ও পুকুর লিজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে উৎপাদন খরচ। খরচের তুলনায় বাজারে মাছের দাম নেই।
পবা উপজেলার পারিলা এলাকার মাছচিাষি তাশামুর এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, গতকাল রোববার ঢাকায় এক গাড়ি মাছ পাঠিয়েছিলেন বিক্রি জন্য। যে দামে মাছ বিক্রি হয়েছে তা গত সপ্তাহের তুলনায় কম। এমনকি এই দাম পাঁচ বছরের মধ্যেও পাননি তিনি। ৬ কেজি ওজনের কাতলা মাছ দাম পেয়েছেন ৩২০ টাকা কেজি। আড়াই কেজির রুই ২৫০ টাকা, তিন কেজির রুই ২৮০ টাকা, সাড়ে তিন কেজি সিলভার ২০০ টাকা, ৭ কেজি ওজনের বিগহেড কার্প ৩০০ টাকা কেজি দরে দাম পেয়েছেন। অথচ বাজার ভালো থাকলে কেজিপ্রতি ১০০ থেকে দেড়শ টাকা বেশি পেতেন বলে আক্ষেপ করেন এই চাষি।
রাজশাহীর কয়েকটি মৎস্য আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় পাইকারী সকল মাছের দাম কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। আমদানি বেশি না থাকলেও দাম কেন বাড়ছে না এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না কেউই।
খুৃচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, বর্তমানে দেশের পরিস্থিতির কারণে মাছের বাজারে খারাপ প্রভাব পড়েছে। মানুষের পকেটে টাকার ঘাটতি।
সবকিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু যেসব জিনিসের উৎপাদন ক্রমাগত সেসবের দাম বাড়েনি। মাছ, মাংস, ডিমের দাম। তবে, পরিস্থিতি ঠিক হলে বাজার ঠিক হবে বলেও আশাবাদী তারা। এছাড়া রাজশাহী সারাদেশে কার্প জাতীয় মাছ উৎপাদনে শীর্ষে থাকায় এখানকার মাছ যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। লাভের আশায় দেখাদেখি মাছচাষ লাভজনক হওয়ায় মাছ চাষে ঝুঁকেছিলেন অনেকে। উৎপাদন বেড়ে গত ১০ বছরের তুলনায় তিনগুণ হয়েছে বলে জানা যায়।
মাছচাষি শফিকুল ইসলাম জানান, তিন বছর আগে ২৫ কেজির মাছের খাদ্যের বস্তার দাম ছিল ৭০০ টাকা। সেই বস্তা এখন ১৩০০ টাকা। আবার বাঁকিতে মাছের খাদ্য নিলে বস্তা প্রতি দুই’শ টাকা বেশি নেয় ডিলাররা। আবার বিঘাতে ৫০ হাজার টাকার নিচে জমি লিজ পাওয়া মুসকিল। মাছ বিক্রি করে মাছের খাবারের টাকাই উঠছে না। ঢাকায় মাছ চালান দিয়েও তেমন সুবিধা হচ্ছে না। এতে নতুন ও ক্ষুদ্র পুকুর চাষিরা লোকসানে পড়েছেন। অনেকে মাছ চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন। দেশের কি পরিস্থিতি বোঝা বড় দায়।
পারিলার মাছচাষি গফুর মোল্লা বলেন, সব মাছ সময় মতো বিক্রি করতে না পারলে অতিরিক্ত মাছ থেকে যায় এবং তাদের বাড়তি খাদ্য খাওয়াতে হয়। টার্গেটকৃত মাছ সময়ের মধ্যে বিক্রি করতে না পারলে বেশি খাদ্য খাইয়ে বড় হয়না কিন্তু উৎপাদন খরচ অনেক বৃদ্ধি পায়। মাছের এমন দরপতন ঘটেছে ধীরে ধীরে। কবে মাছের বাজার ঠিক হবে তা বলতে পারছি না। এভাবে চলতে থাকলে মাছ চাষ বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। আমরা দীর্ঘদিনের মাছচাষি টিকে থাকার জন্য ব্যাংক লোনও পাইনা। কিছু করার নাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাছচাষি বলেন, দেশে যে পরিমাণ মাছ চাষ হচ্ছে এতো মাছের দরকার নাই। ইএনও পুকুর কাটা বন্ধ করেছে কিন্তু রাতে পুকুর হচ্ছে ফসলী জমি। অতিরিক্ত পুকুর খনন একদিকে গেছে ফসলী জমি অন্যদিকে অতিরিক্ত মাছের চাপে ঘটেছে এমন দরপতন। আর এই সুযোগ নিয়েছে পাইকাররা। এতে মাছচাষিদের দোষ বলেই মনে হচ্ছে। দাম তো কমবে আমদানি বাড়লে। আর পকেটের অবস্থা খারাপ সবারই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্বিক পরিস্থিতির কারণেই মাছের এমন দরপতন ঘটেছে। চাষি ও পাইকার উভয়েই আস্থা সংকটে ভুগছেন। আতঙ্কের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মাছের বাজার ঠিক হবে। সবকিছু মিলিয়ে লোকসানে উৎপাদন থেকে সরে আশার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অনেকেই। তবে দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আরও দুঃসময় ভাগ্যে লেখা থাকবে দুর্গাপুরের মৎস্যচাষিদের।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, মাছের দাম কমেছে সেটা আমরা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি। শীতকালে প্রাকৃতিক মাছের কারণে চাষের মাছের দাম কমে। বাজারে প্রচুর পরিমাণ মাছের আমদানি। মূলত আমদানির কারণেই মাছের দাম কমেছে। খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় এসব মাছ ধরছে মানুষ-আর বাজারে বিক্রি করছে। এছাড়া ইলিশ মাছের নিষেধাজ্ঞা না থাকার কারনে বাজারে ইলিশও আছে। সবমিলিয়ে দাম কমেছে।