করোনাকালে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, সবকিছু স্থবির, সময় কাটছিল না, তখনই মাথায় চিন্তাটা আসে জাহিদুল আলমের। পড়াশোনা তো শেষ পর্যায়ে, এখন কীভাবে কী করবেন ভাবতে থাকেন। পরামর্শ নেন বাবা ও ভাইদের। এরপর একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে উদ্যোক্তা তৈরিবিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন মুরগির খামার। জাহিদুল এখন পুরোদস্তুর খামারি। এই খামার ঘিরেই দিনবদলের স্বপ্ন তাঁর।
জাহিদুল আলম ওরফে জাবেদের (৩০) বাড়ি সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে দুই ভাই প্রবাসে। বাড়িতে জাহিদুল আর ছোট ভাই জাবের আলম। জাহিদুল ২০২১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন।
জাহিদুল আলম জানান, করোনার সময়ে একধরনের হতাশায় পড়েন তিনি। ২০২১ সালের শেষ দিকে একজনের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্টারপ্রাইজেসের (আইডিই) এক কর্মীর সঙ্গে। সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের আর্থিক সহযোগিতায় আইডিই উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় জাহিদুল হাঁস-মুরগির ব্যবসার পরিকল্পনা ও কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ২০২২ সালের এপ্রিলে বাড়িতে ৪০০ সোনালি মুরগির বাচ্চা নিয়ে খামার শুরু করেন। শুরুতে তাঁর ব্যয় হয় ৯০ হাজার টাকা। প্রথম চালানে লাভ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। দ্বিতীয় চালানে অবশ্য লাভ করতে পারেননি। ওই বছরের জুনে বন্যায় খামারের সব মুরগির বাচ্চা ভেসে মারা যায়। বন্যার পর আবার শুরু করেন। এবারও পরিবার অর্থ দিয়ে সহায়তা করে তাঁকে। আইডিই থেকে কিছু প্রণোদনা পান। এখন তাঁর খামারে এক হাজার সোনালি মুরগির বাচ্চা আছে।
জাহিদুলের বাড়িটি মহাসিং নদের তীরে। বসতঘরের পূর্ব পাশে নদের তীর ঘেঁষে খামারের টিনের বেড়া ও টিনের চালার ঘর। সেটিতে মুরগির বাচ্চাদের পরিচর্যা করছিলেন জাহিদুলের ছোট ভাই জাবের আলম (২৭)। জাবের পড়াশোনার জন্য থাকেন সিলেটে। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। বাড়িতে এলে বড় ভাইয়ের খামারে সময় দেন।
জাবের আলম বলেন, ‘এটা থেকে উৎসাহ পাচ্ছি। চাকরির বাজারের যে অবস্থা, তাতে নিজে থেকে আমিও কিছু একটা করব বলে ভাবছি। একসময় মনে সংকোচ ছিল, এখন সেটা কেটে গেছে।’
মুরগির বাচ্চাদের খাবার দিতে দিতে জাহিদুল আলম বলেন, এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চা সিলেট থেকে কিনে আনেন। এরপর খামারে এগুলোর যত্ন–আত্তি করতে হয় ৫২ থেকে ৫৫ দিন। এই সময়ে একেকটি ৬০০ গ্রাম ওজন হয়। এরপর বিক্রি করেন। শুরুতে খামারের ঘরটি ছোট ছিল। এখন আরও এক লাখ টাকা ব্যয়ে ঘরটি বড় করেছেন। ইচ্ছা আছে আরও মুরগির বাচ্চা বাড়ানোর। এখন খামারে যে পরিমাণ মুরগি আছে, তা বিক্রি হলে এই চালানে ৫০ হাজার টাকা লাভ হবে বলে আশা তাঁর।
জাহিদুল আলম বলেন, ‘এখন বুঝতে পারছি নিজে থেকে কিছু একটা করায় অন্য রকম আনন্দ আছে। আমাকে দেখে এলাকার অন্য যুবকেরাও চেষ্টা করছেন। আমি ব্যবসাটাকে আরও বড় করব, সেভাবেই পরিকল্পনা করছি।’
জাহিদুল আলমের বাবা মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, ছোট ছেলেকেও বলেছি, চাকরির পেছনে না দৌড়ে তুমিও একটা কিছু করো। কষ্ট করলে ভালো ফল হবেই।’
আইডিইর উদ্যোক্ত উন্নয়ন কর্মকর্তা আহাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সুনামগঞ্জের তিনটি উপজেলায় কাজ করেছেন। সদস্য ছিল ৯০০ জন। এর মধ্যে উদ্যোক্তা হিসেবে ৬০০ জন বিভিন্নভাবে কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে জাহিদুল আলম একজন। সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।
নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ মাসুক আলী বলেন, ‘জাহিদুল শিক্ষিত ছেলে। এখন সে নিজে মুরগির খামার দিয়েছে। এটা দেখে এলাকার অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছে। তারাও হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন, মাছের খামার করছে। বিষয়টি আমাদেরও ভালো লাগছে।’
সূত্র – প্রথম আলো