পশ্চিমবঙ্গের লেখক কল্লোল লাহিড়ীর উপন্যাস ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’। এর কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে ওয়েব সিরিজও। পাবনায় এই নামে একটি রেস্তোরাঁও চালু হয়েছে। উপন্যাসের মূল চরিত্র খুলনার মেয়ে ইন্দুবালার বাবার বাড়ি থেকে পাঠানো জোড়া ইলিশের তত্ত্ব যায় কলকাতার শ্বশুরবাড়িতে। বিয়ের পর প্রথম দিন নববধূ ইন্দুবালাকে শ্বশুরবাড়ির ছোট্ট বাগানে দাঁড় করিয়ে দেন শাশুড়ি।
বাগানে ইন্দু খুঁজে পায় পুঁইশাকের নতুন পাতা। সেই পুঁইশাকের সঙ্গে ইলিশের মাথা দিয়ে ‘ছ্যাঁচড়া’ রান্না করে। নতুন বউয়ের হাতের রান্না দারুণ স্বাদের হয়েছিল। ইন্দুবালার ‘অত বড় ডাকাত চেহারার স্বামী আধকড়াই ছ্যাঁচড়া একা নিজেই সাবাড় করেছিলেন’।
বাঙালির ইলিশপ্রীতি মাত্রাছাড়াই বটে। ইলিশে বাঙালির প্রেম পুরোনো, অকৃত্রিম। কিন্তু সাধ থাকলেও এখন ইলিশ অনেকের কাছে অধরা থেকে যায় এর দামের জন্য। কবি বুদ্ধদেব বসুর কথায়, ‘জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব’ পড়ে থাকলেও তাকিয়ে দেখা ছাড়া অনেকেরই কিছু করার থাকে না; যদিও ফি বছর দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। আর এই বর্ষা মৌসুমেই সাধারণত ইলিশ ধরা পড়ে বেশি। সেই বুদ্ধদেব বসুর কবিতাতেই পাই, ‘এল বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।’
সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময় অবশ্য নদীতে ‘টুকিটাকি’ ইলিশ মিলেছে বলে জানান ফজলু গাজী। নদীতে মাছ কম ধরা পড়ার কারণ প্রসঙ্গে কম বৃষ্টিকে দুষলেন এই ব্যবসায়ী। তাঁর কথা, ‘বৃষ্টি না পাইলে ইলিশ আসপে কেমন করে। তবে এখন বৃষ্টি শুরু হইছে। ইলিশ ভালো পড়তে পারে।’
কিন্তু এখন আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণ। পুরো আষাঢ় মাস সমুদ্রে মাছ ধরা নিষেধ ছিল। নদীতে বিধিনিষেধ ছিল না বটে, কিন্তু সাগরে ইলিশের জন্য জেলেরা ছুটতে পারেননি। নদীতে যৎসামান্য ইলিশ ধরা পড়েছে। বাজারে তাই ইলিশের দাম চড়া। গত সোমবার থেকে সাগরে মাছ ধরার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। মৎস্য–গবেষকেরা এরই মধ্যে ইলিশের উৎপাদন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। এবার ‘জলের শস্যের’ উৎপাদন কেমন হবে, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীও করছেন। ইলিশ এবার কেমন হবে, সে প্রশ্নে গবেষকদের কথা শোনার আগে জানা যাক জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীরা কী বলছেন।
দুই মাসের বেশি সময় ধরে সাগরে মাছ ধরা বন্ধের পর ২৩ জুলাই রাত থেকে শুরু হয়েছে সমুদ্রে মাছ ধরা। ওই দিনই পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মহিপুর বন্দর থেকে সাগরের দিকে ছুটেছে জেলেদের মাছ ধরার নৌকা। মহিপুর বন্দরের মাছ ব্যবসায়ী ফজলু গাজীর পাঁচটি নৌকা। তবে সাগরে প্রবল ঢেউ থাকায় নৌকা ফিরে আসতে বাধ্য হয় বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
মহিপুর বন্দর থেকে আন্ধারমানিক নদের মোহনায় যেতে আধা ঘণ্টা সময় লাগে। জেলেরা আরও গভীরে গিয়ে মাছ ধরেন। সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময় অবশ্য নদীতে ‘টুকিটাকি’ ইলিশ মিলেছে বলে জানান ফজলু গাজী। নদীতে মাছ কম ধরা পড়ার কারণ প্রসঙ্গে কম বৃষ্টিকে দুষলেন এই ব্যবসায়ী। তাঁর কথা, ‘বৃষ্টি না পাইলে ইলিশ আসপে কেমন করে। তবে এখন বৃষ্টি শুরু হইছে। ইলিশ ভালো পড়তে পারে।’
তাঁরা প্রতিবছর বলেন, আগেরবার ভালো ছিল। আগেরবারের হিসাব কি তাঁরা রাখেন? প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। এখন নদীতে ইলিশ কম হবে—এটাই স্বাভাবিক। আগস্টের আগে ইলিশ ভালো করে মিলবে না, এটা বলা যায়। এখন ইলিশের প্রাপ্তির সময় পরিবর্তন হয়ে গেছে।
মো. আনিছুর রহমান, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
এটি দেখা হয় মূলত অক্টোবর মাসের শেষ দিকে। সর্বশেষ গত বছরের ইলিশের প্রজনন–সফলতা ৫২ দশমিক ৩২ শতাংশ ছিল বলে জানান মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম। এর আগের বছর বছরের প্রজনন-সফলতা ছিল ৫১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তার আগের বছর এটি ছিল ৫১ দশমিক ২ শতাংশ।
ইলিশের সম্ভাব্য উৎপাদন বোঝার জন্য আরেকটি নির্ণায়ক হলো জাটকার উৎপাদনের হার। আশরাফুল আলম বলেন, ইলিশের প্রজনন–সফলতার হার গত বছর এর আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। এর পাশাপাশি জাটকার বাঁচার হারও বেড়েছে। এ বছর জাটকা বাঁচার হার হলো ৪০ হাজার ২৭৬ কোটি। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ৩৯ হাজার ৩১৫ কোটি। ইলিশের বিচরণক্ষেত্রগুলোয় পরীক্ষা করে জাটকার পরিমাণ মাপা হয় বলে জানান আশরাফুল আলম।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান মনে করেন, এবার ইলিশের উৎপাদন আগের বছরের চেয়ে বেশি হবে।
নদীতে ইলিশের উৎপাদন কম হওয়া নিয়ে চাঁদপুরের ব্যবসায়ীদের আক্ষেপ প্রসঙ্গে আনিছুর রহমান বলেন, ‘তাঁরা প্রতিবছর বলেন, আগেরবার ভালো ছিল। আগেরবারের হিসাব কি তাঁরা রাখেন? প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। এখন নদীতে ইলিশ কম হবে—এটাই স্বাভাবিক। আগস্টের আগে ইলিশ ভালো করে মিলবে না—এটা বলা যায়। এখন ইলিশের প্রাপ্তির সময় পরিবর্তন হয়ে গেছে।’
ইলিশ রক্ষায় তিন দফার নিষেধাজ্ঞার ব্যবস্থা চালু আছে দেশে। প্রথম দফায় ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত, দ্বিতীয়বার ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই এবং তৃতীয় দফায় অক্টোবর মাসের ২২ দিন।
মৎস্য–গবেষক আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মার্চ ও এপ্রিলের নিষেধাজ্ঞায় জাটকা ধরা বন্ধ হয়। দ্বিতীয় দফায় মে থকে জুলাইয়ের শেষে যে নিষেধাজ্ঞা, তাতে রক্ষা পায় অপেক্ষাকৃত তরুণ ইলিশ আর শেষ দফা অর্থাৎ অক্টোবর মাসে মা ইলিশ রক্ষা পায়। যদি নিষেধাজ্ঞা ঠিকমতো পালন করা হয়, তবে সাগর থেকে নদী এবং নদী থেকে ইলিশের পরিভ্রমণ সহজতর হয়। দেখা গেছে, একাধিকবার পরিভ্রমণ করা ইলিশ অনেক পুষ্ট হয়।
মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার প্রধান মাসুদ আরা মমি বলেন, এবারও ইলিশের ভালো উৎপাদন আশা করছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘গত বছরের প্রায় পুরো সময় আমরা ইলিশ পেয়েছি। আর এবার মাছ ধরা বন্ধের কর্মসূচিগুলো সফলতার সঙ্গে শেষ হয়েছে। নজরদারি আগের চেয়ে বেড়েছে। এবার জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৩০ দিন জাটকাবিরোধী চিরুনি অভিযান হয়েছে। আগের বছরগুলোয় এই কর্মসূচি ১৫ দিন করা হতো।’
২০০৬-০৭ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৭৯ হাজার ১৮৯ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৩ মেট্রিক টন। এই সময়ে উৎপাদন বেড়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪০৪ মেট্রিক টন বা ১০২ শতাংশ।
ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও এর প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৩। পরে ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০২১-২২ সালে প্রবৃদ্ধি আরও কমে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
আরেক বিজ্ঞানী আনিছুর রহমানের কথা, ‘আমরা দেশের সর্বোচ্চ ইলিশ উৎপাদন সাত লাখ মেট্রিক টন নির্ধারণ করেছি। এর বেশি হবে না। কিন্তু এখন ধারাবাহিকভাবে পাঁচ লাখ মেট্রিক টনের বেশি হচ্ছে।’ এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি।