চট্টগ্রামে মাছের চাহিদার ৭০ শতাংশ মিরসরাই থেকে পূরণ হয়। গত পাঁচ বছরে এ উপজেলায় জলাভূমি না বাড়লেও আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের ফলে বাড়ছে উৎপাদন। বিগত পাঁচ বছরে উৎপাদন বেড়েছে ৮ হাজার ৬৭৭ টন। গত বছর উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভায় মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৮ হাজার ২২৫ টন। যার বাজার মূল্য ৯৬৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এসব মাছের সিংহভাগ উৎপাদন হয়েছে ওসমানপুর ও ইছাখালী ইউনিয়নের মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায়।
স্থানীয় মৎস্য চাষীরা জানান, ফেনী নদীর মিরসরাই-সোনাগাজী অংশের উপকূলীয় অঞ্চলকে প্লাবন থেকে রক্ষায় ১৯৮৪ সালে ৫০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করে সরকার। বাঁধ নির্মাণের ফলে দুই পাশে হাজার হাজার একর চর জেগে ওঠে। এসব চরই আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয় স্থানীয় মৎস্য চাষীদের কাছে। ধীরে ধীরে মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় গড়ে ওঠে পরিকল্পিত মৎস্য প্রকল্প। ১৯৯৬ সালে বেশ কয়েকজন মৎস্য চাষী আধুনিক পদ্বতিতে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ শুরু করেন। এরপর থেকে মেরিডিয়ান, বসুন্ধরা, আবুল খায়েরের মতো নামিদামি শিল্প গ্রুপ বাণিজ্যিকভাবে মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় মৎস্য চাষ শুরু করে। শুধু মৎস্য চাষ নয়, এখানে উৎপাদন হয় মনোসেক্স তেলাপিয়া জাতের মাছের পোনা। যা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।
জানতে চাইলে মিরসরাই মৎস্য সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় আমার ১৫০ একর মৎস্য প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পে বছরে প্রায় দেড় হাজার টন মাছ উৎপাদন হয়। মিরসরাইয়ে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছে অনেকে।’
মিরসরাই উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভায় ৭ হাজার ৮০৬ একর জলাশয়ে মাছ চাষ হয়। এগুলোর মধ্যে ৫ হাজার ৭৪৬ একর রয়েছে মৎস্য জোন হিসেবে খ্যাত মুহুরী প্রজেক্টে। ২০১৮ সালে উপজেলায় ৩৯ হাজার ৫৪৮ টন মাছ উৎপাদন হয়েছিল। যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৪৭৪ কোটি ৫৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এসব মাছের মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙাশ, তেলাপিয়া, পাবদা, শিং ইত্যাদি। ওই বছর কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন হয়েছিল ২৩ হাজার ৭২৮ টন। ২০১৯ সালে বেড়ে যায় মাছের উৎপাদন। ওই বছর ৩ হাজার ৯১২ টন বেড়ে উৎপাদন দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ৪৬০ টনে। যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৬৫১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এগুলোর মধ্যে কার্প জাতীয় মাছ ছিল ২৬ হাজার ৭৬ টন।
২০২০ সালে আরো ১ হাজার ২৮২ টন বেড়ে মাছের উৎপাদন দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৭৪২ টনে। যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৭১৫ কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। এগুলোর মধ্যে কার্প জাতীয় মাছ ছিল ২৬ হাজার ৮৪৫ টন। ২০২১ সালে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ১ হাজার ৬৪ টন। ওই বছর মোট উৎপাদন হয়েছিল ৪৫ হাজার ৮১০ টন। যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৮২৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এতে কার্প জাতীয় মাছ ছিল ২৭ হাজার ৪৮৬ টন।
এছাড়া ২০২২ সালে উপজেলার ৭ হাজার ৮০৬ একর জলাশয়ে ৪৮ হাজার ২২৫ টন মাছ উৎপাদন হয়। যা আগের বছরের তুলনায় ২ হাজার ৪১৫ টন বেশি। যার বাজার মূল্য প্রায় ৯৬৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এগুলোর মধ্যে কার্প জাতীয় মাছ ছিল ২৮ হাজার ৯৩৫ টন।
মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মাছ উৎপাদনে মিরসরাই উপজেলা প্রসিদ্ধ স্থান। জলাভূমি না বাড়লেও আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের ফলে মিরসরাইয়ে প্রতি বছরই বাড়ছে মাছের উৎপাদন। চট্টগ্রামের প্রায় ৭০ ভাগ মাছের চাহিদা পূরণ হয় মিরসরাইয়ের বিভিন্ন মৎস্য প্রকল্প থেকে।’
এদিকে মিরসরাইয়ে উৎপাদিত মাছের সিংহভাগ আসে ইছাখালী ও ওসমানপুর ইউনিয়নে অবস্থিত মুহুরী প্রজেক্ট থেকে। মুহুরী প্রজেক্টের মিরসরাই অংশে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৭৪৬ একর জলাভূমি। এর মধ্যে ইছাখালী ইউনিয়নে ২ হাজার ৫৪৬ একর ও ওসমানপুর ইউনিয়নে রয়েছে ৩ হাজার ২০০ একর জলাভূমি। সেখান থেকে প্রতি বছর মাছ উৎপাদন হয় ৩৫ হাজার ৪৯৮ টন। যার বাজার মূল্য প্রায় ৭০৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
অন্যদিকে মাছ বিক্রির জন্য বারইয়ারহাট পৌর এলাকায় গড়ে উঠেছে উত্তর চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ মাছের আড়ত। এছাড়া মিঠাছরা, বড়তাকিয়ায় রয়েছে মাছের আড়ত। আড়তগুলোয় দৈনিক কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। যার সিংহভাগ আসে মুহুরী প্রজেক্ট থেকে। মিরসরাইয়ে বছরে মাছের চাহিদা রয়েছে প্রায় ১০ হাজার টন। এ এলাকার উৎপাদিত মাছ উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে চট্টগ্রামের ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে।
সূত্র: বনিক বার্তা।