কৃষি হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির মুল চালিকা শক্তি। আর মৎস্য শিল্প হলো কৃষি খাতের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনায় একটি উপখাত। মৎস্য খাতের মধ্যে চিংড়ি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী রপ্তানি পণ্য। দেশের মোট উৎপাদিত চিংড়ির বেশীরভাগই উৎপাদিত হয় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায়।
তাছাড়া চট্রগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলেও চিংড়ির চাষ হয়ে থাকে। সাদা সোনা হিসেবে খ্যাত রপ্তানি শিল্প চিংড়ি থেকে যেমন অধিক মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি অন্যদিকে এই শিল্প থেকে অর্থনৈতিক ক্ষতিরও সম্ভাবনা রয়েছে। এই শিল্পে অধিক উৎপাদনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি অপরিকল্পিত চাষ ব্যব¯হাপনা ও মান সম্পন্ন পোনার অপ্রতুলতায় ঘেরের বা খামারের চিংড়িতে মড়কের কারণে চিংড়ি ফসল বিনষ্ট হয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাও থাকে।
বাংলাদেশে চিংড়ি উৎপাদন ফি বছরই বাড়ছে, যা ক্রমবর্ধমান। বিগত ২০১৮-১৯ সালে মোট চিংড়ির উৎপাদন ছিল প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার মে. টন। আর উৎপাদিত চিংড়ির ৪০ হাজার মে. টন চিংড়ি বিশ্বে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে। আর অবশিষ্টাংশ আভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মিটিয়েছে (সূত্রঃ মৎস্য অধিদপ্তর)। অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এর হিসাব মতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ চিংড়ি রপ্তানি করে ৩,৫২৭ কোটি টাকা আয় করেছে । তবে বিগত পাচ বছর ধরে চিংড়ির রপ্তানি বাজার অ¯িহতিশীল এবং বাজার প্রতিযোগিতামূলক।
উপরন্তু বিশ্বব্যাপি কোভিড-১৯ এর কারণে চিংড়িসহ সী-ফুড বাণিজ্যে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয় (চিত্র ১)। ফলে দেশের চিংড়ি চাষী থেকে শুর করে আড়তদার, প্রক্রিয়াজাতকারী, রপ্তানীকারক, কর্মরত শ্রমিক সকলেই ক্ষতিগ্রস্থ। করোনার কারণে আমদানিকারক কর্তৃক একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিলের ফলে ব্যবসায়িক ক্ষতি ছাড়াও চিংড়ি শিল্পে নিয়োজিত বিশাল শ্রমিক গোষ্ঠির অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছে বা আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে উপকুলে সার্বিক খাদ্য ও পুষ্টি নিরপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
চিংড়ি চাষ: একটি সম্ভাবনার প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়
অপরদিকে চিংড়ি চাষে রোগ-বালাই ছাড়াও বড় বাঁধা হলো চিংড়ি চাষের বিভিন্ন উপকরণ বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের মূল্য। ফলে চিংড়ির দাম কম হলে চাষীদের খরচ উঠিয়ে লাভ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই, চিংড়ি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের প্রণোদনার আওতায় আনা, ঋণ মওকুফসহ পূনরায় সহজ শর্তে নতুন ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা অতীব জরুরী।
চিংড়ি চাষে প্রতীয়মান বিদ্যমান সমস্যাবলি
চিংড়ি চাষে বিদ্যমান সমস্যাদির মধ্যে অন্যতম হলো ঃ (ক) রোগমুক্ত, সবল ও সুস্থ পোনার অভাব (খ) প্রাকৃতিক বিপর্যয় (গ) চাষীদের আর্থিক ভারসাম্যহীনতা (ঘ) চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও প্রয়োগের অভাব (ঙ) সুষম ও উপযুক্ত পুষ্টিমান সমৃদ্ধ চিংড়ি খাদ্যের অভাব বা উচ্চ মূল্য (চ) হ্যাসাপ(HACCP) ভিত্তিক মাননিয়ন্ত্রণ বিষয়ে জ্ঞানের অভাব ও প্রয়োগ দূর্বলতা (ছ) স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ব (জ) অবকাঠামোর দূর্বলতা ও অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা (ঝ) ঋণের স্বল্পতা ও সুদ বিষয়ক জটিলতা ইত্যাদি। এছাড়া ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা লোড শেডিং এর কারণে বরফকল বন্ধ ও প্রক্রিয়াজাত কারখানায় চিংড়ির গুণগতমান বিপন্ন হওয়াও চিংড়ি শিল্পে বড় বাঁধা।
তবে আমাদের বড় দূূর্বলতা হলো সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কালক্ষেপণ। চিংড়ি চাষের শুরু থেকে আমরা শুধু বাগদা ও গলদা চাষের ওপরই জোর দিয়ে আসছি। কিন্তু প্রথম থেকেই অন্যান্য প্রজাতির চিংড়ি যেমন হরিণা, চাকা ইত্যাদি চিংড়ির চাষাবাদ ও পোনা উৎপাদন এবং চিংড়ির রোগ-বালাই প্রতিকারে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে দিন দিন বিশ্বব্যাপী ভেনামী চিংড়ির প্রচলন ও বাজার চাহিদার কারণে প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়েছি। যতদূর জানা যায়, ভেনামী চাষ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে আমরা বেশ দেরী করে ফেলেছি। মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ওপর যে কোন খাদ্য বা ভোগ্যপণ্যের চাহিদা নির্ভর করে।
বর্তমানে দেখা গেছে যে, ভেনামির মূল্য কম হওয়ায় জনপ্রিয় বাগদা এর চেয়ে আর্ন্তজাতিক বাজারে ভেনামির চাহিদা বেড়ে চলেছে। প্রায় ৬৭টি দেশ এখন ভেনামি চাষ করছে এবং বিশ্বে মোট রপ্তানির প্রায় ৭৭ শতাংশই ভেনামির দখলে। পক্ষান্তরে বাগদা চিংড়ির রপ্তানি বাজার মাত্র ১১ শতাংশ। অতিসম্প্রতি সরকার শুধুমাত্র রপ্তানিকারকদের পরীক্ষামুলকভাবে ভেনামি চাষের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো ভেনামি চাষের জন্য দেশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও দক্ষ জনবল আছে কি না? সেজন্য বিদেশ হতে দক্ষ কর্মী আনাসহ দেশের বিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসাথে নিবিড় পদ্ধতিতে ভেনামী চাষের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। চাষীদের বাস্তব জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ অভিজ্ঞতার অভাবে এ প্রকার চিংড়িতে ভাইরাসের আক্রমণ দেখা দিলে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিভিন্ন গবেষণা তথ্য হতে জানা যায় যে, ভেনামীর পিএল অবস্থায় মারাত্মক Taura syndrome virus দেখা দেয়। তাই অবশ্যই ভেনামি চাষের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস যেন না ছাড়ায় সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আমাদের স্থানীয় প্রজাতির চিংড়ির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। উল্লেখ্য যে, চিংড়ি চাষে রোগ প্রতিরোধে DNA Probe Polymerse Chain Reaction (PCR) প্রযুক্তির সাহায্যে চিংড়ির ব্রুডস্টক, পোষ্টলার্ভা ও খামারে চাষকৃত চিংড়ির রোগ সনাক্তকরণ করা যায়। অবশ্যই উপযুক্ত ল্যাবরেটরী কর্তৃক সনদপত্র প্রদানের পর রোগমুক্ত চিংড়ি খামারে চাষ করতে হবে। তবে PCR প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাইরাস সনাক্ত করতে ৮-৯ ঘন্টা সময় লেগে যায়। তাই মাঠ পর্যায়ে খুব অল্প খরচে এবং অল্প সময়ের মধ্যে ফিল্ড কীটের মাধ্যমে ভাইরাস সনাক্ত করতে পারলে সুবিধা হত। এ ধরনের সুযোগ সুবিধা কোথায় রয়েছে তা আগে থেকে চাষীদের জানা প্রয়োজন এবং অথবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে চাষীদের সহায়তার ব্যবস্থা নিতে হবে।