বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলায় বাণিজ্যিক ভাবে কুচিয়া মাছ চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু সেটা অতি সামান্য, তাছাড়া প্রকৃতি থেকে বিপুল পরিমানে কুচিয়া আহরণ করে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেমন জরুরী, তেমনি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা তার থেকে বেশী জরুরী।
প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রেখে অধিক বৈদাশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে এখনই বানিজ্যিকভাবে কুচিয়া মাছ চাষ পদ্ধতির প্রচলন করা খুবই জরুরী । এক দিকে যেমন প্রকৃরি ভার সাম্য রক্ষা হবে, তেমনিভাবে কুচিয়া মাছ চাষ করে বিপুল পরিমানে বৈদাশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্বভ হবে।
কুচিয়া মাছ চাষের সঠিক পদ্ধতি বা নিয়মঃ
কিভাবে করবেন পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতঃ
কুচিয়া মাছ মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত গর্ত করে এক পুকুর থেকে অন্য পুকুরে চলে যায়। তাই নিদিষ্ট পুকুরে কুচিয়া রাখার জন্য পুকুরের তলদেশ ও চারপাশে পাকা করা সম্ভব হলে ভালো তা না হলে রেক্সিন বা মোটা পলিথিন অথবা ট্টিপল দিয়ে পুকুরের তলদেশও চারপাশ ঢেকে দেওয়া উত্তম। পুকুরের তলদেশ ঢেকে দেওয়ার পর ২ থেকে ৩ ফিট মাটি দিয়ে দিতে হবে। পুকুরের একপাশে কম্পোস্টের স্তুপ করে রাখতে হবে।
অথবা ১ ইন্চি পরিমানে সারা পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমাণে কচুরি পানা দিতে হবে। যখন কুচিয়ার প্রজনন মৌসুম সে সময়ে পুকুরে কচুরি পানা তিন চতুর্থাংশ দিতে হবে। কুচিয়া মাছ কম গভীরতা সম্পন্ন পুকুরে বা বিলে পাওয়া যায় তাই তাদের অনুকুল পরিবেশ তৈরি করতে হবে প্রজনন কালে পানির গভিরতা ১ ফুট পর্যন্ত রাখতে হবে।
কুচিয়া মাছের পরির্চযাঃ
কুচিয়া মাচ সংগ্রহের জটিলতার কারণে মুখে আঘাত পেয়ে থাকে । তাছাড়া দীর্ঘ দিন অধিক ঘনত্ব ড্রামে বা চৌবাচ্চায় থাকার কারণে পেটের নিচে ছোপ ছোপ রক্ত জমাট বাধা দেখা যায়। আঘাত পাপ্ত কুচিয়া মাছ আলাদা করে আঘাতের পরিমাণ বিবেচনা করে ০.২-০.৫ মি লি এন্টিবায়োটিক ও রেনামাইসিন প্রয়োগ করতে হবে।
কুচিয়া মাছের খাদ্য ব্যবস্থাঃ
কুচিয়া মাছকে খাদ্য হিসাবে- জিবিত ছোট মাছ ও শামুক-ঝিনুক সরবরাহ করতে হবে। কুচিযা নিশাচর প্রাণী তাই প্রতিদিন নিদিস্ট সময়ে খাদ্য দিতে হবে এবং এর সাথে সম্পুরক খাদ্য দিতে হবে।
কুচিয়া মাছ সংগ্রহঃ
কুচিয়া মাছ পালনের জন্য ফ্রেবুয়ারী থেকে মার্চ মাসের মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে। কুচিয়া মাছ সংগ্রহের পর তাকে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পুকুরে বা হ্যাচারিতে রেখে ৫-৭ দিন পরিচর্যা করতে হবে।
প্রজননের জন্য কুচিয়া মজুদঃ
প্রজননের জন্য সুস্থ্য সবল কুচিয়া স্ত্রী ও পুরুষ শনাক্ত করার পর ১৫০-২০০ গ্রাম ওজনের পুরুষ ও ২৫০-৩৫০ গ্রাম ওজনের স্ত্রী কুচিয়া মাছকে প্রস্তুতকৃত পুকুরে ১:২ অনুপাতে শতাংশে ৩০টি করে মাছ মজুদ রাখতে হবে।
কুচিয়া মাছের
বৈশিষ্ট্যঃ
- সাপের মতো দেখতে হলেও কুচিয়া একটি মাছ।
- কুচিয়া মাছের ফুলকা থাকেনা, তবে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য মাথার দুই পাশে থলে আকৃতির অঙ্গ আছে।
- এ মাছের শরীর লম্বা বেলুনাকৃতির হয়, এবং স্লাইম নিঃরিত হয় তাই শরীর পিচ্ছিল হয়।
- এরা সামনে ও পেছনে দুই দিকেই চলাচল করতে পারে।
- দেখে কুচিয়া মাছকে আশ বিহীন মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে এদের গায়ের চামড়ার নিচে ক্ষুদ্রকৃতির আঁশ বিদ্যমান।
- কুচিয়া, যে কোন প্রতিকুল পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।
- কুচিয়া স্বপ্লমাত্রার অক্সিজেন ও উচ্চ তাপমাত্রা সয্য করতে পারে।
- স্বপ্ল ও গভির জলাশয়ে এরা সহজেই বসবাস করতে পারে।
- কুচিয়া অধিক শক্তিশালী এবং ধৈর্য্যশীল প্রকৃতির মাছ।
- কুচিয়া মাটিতে গর্ত করে ও জলজ আর্বজনার নিচে লুকিয়ে থাকে, অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ পছন্দ করে।
- কুচিয়া রাক্ষুসে স্বভাবের ও নিশাচর প্রাণী।
- কুচিয়া ছোট ছোট মাছ, পোকামাকড় ও শামুক-ঝিনুক খেয়ে জীবন ধারণ করে।
কুচিয়া মাছের প্রজনন বৈশিষ্ট্যঃ
কুচিয়া মাছ বছরে একবার মাত্র প্রজনন করে থাকে। কুচিয়া মাছ লিঙ্গ পরিবর্তন করতে সক্ষম তাই বাহ্যিক বর্ণের উপর ভিত্তি করে পুরুষ ও স্ত্রী কুচিয়া মাছকে আলাদা করা সম্ভব না । প্রজননের সময় স্ত্রী কুচিয়া মাছের গায়ের রং হলুদ হয়ে থাকে আর পুরুষ কুচিয়া মাছের গায়ের রং কালো বর্ণের হয়ে থাকে।
প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী কুচিয়া মাছের জননাঙ্গ কিছুটা স্ফিত হয় এবং পেটে ডিম থাকার কারনে পেটের দিকে যথেষ্ট ফোলা থাকে। স্ত্রী কুচিয়া মাছ থেকে পুরুষ কুচিয়া মাছ সাইজে ছোট হয়ে থাকে। একটি পরিপক্ক কুচিয়ার ওজন হয় ২০০-৪০০গ্রাম এবং গড়ে ২৫০ থেকে ৬৫০ টি ডিম দিয়ে থাকে।
ডিম দেওয়ার সময় হলে কুচিয়া মাটিতে আকাবাকা গর্ত করে থাকে। কুচিয়া এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রজনন করে থাকে। কুচিয়া মাছ নিজেদের তৈরি গর্তে ডিম দেয় এবং সেখান থেকেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
সে সময়ে মা কুচিয়া ডিমের খুব কাছাকাছি থেকে ডিম পাহারা দেয় এবং পুরুষ কুচিয়া আশেপাশে ঘোরা ফেরা করে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়া থেকে শুরু করে ডিম্বথলি নিঃশোষিত না হওয়া পর্যন্ত মা কুচিয়া মাছ শত্রুর হাত থেকে বাচ্চাদের রক্ষা করে থাকে।
কুচিয়া মাছের ঔষধি গুণ
আমাদের দেশে যে সকল উপজাতিরা আছে , সে সকল উপজাতি জনগোষ্টির মাঝে এ মাছ ব্যাপক জনপ্রিয়। তারা বিশ্বাস করে এ মাছ খেলে শারীরিক দুর্বলতা অ্যাজমা, রক্তক্ষরণ রক্তশূন্যতা ইত্যাদি রোগ-সমুহ থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া যায়। তাদের ধারনা কুচিয়া মাছের বায়ু-থলি তাজা বা শুকনা অবস্থায় খেলে অ্যাজমা ও বাতজ্বর বাড়ে না।
কুচিয়া মাছের মাংসের সুপ বা বিবিন্ন ধরনের হাবস মিশিয়ে তরকারী রান্না করে খেলে পাইলস, এ্যামেনিয়াসহ বিভিন্ন রোগ সেরে যায়। অনেক গবেষণায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে উপজাতিদের বিশ্বাসের সঙ্গে সহমত পোষন করে।
কুচিয়া মাছের পুষ্টিমানঃ
পুষ্টির দিক দিয়ে কুচিয়া মাছে অন্য মাছের চেয়ে তুলনায় বেশি খাবার যোগ্য। প্রতি ১০০ গ্রাম কুচিয়া মাছে ১৮.৭ গ্রাম প্রোটিন, ০.৮ গ্রাম চর্বি, ২.৪ গ্রাম কার্বহাইড্রেট, ১৪০০ মাইক্রো গ্রাম ভিটামিন, ১৮৫ গ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে। তাছাড়া ১০০ গ্রাম কুচিয়া মাছে ৩০০ কিলোক্যালরির বেশি শক্তির জোগান দিতে পারে।
মৎস্য পশুসম্পদ বার্তা বই