পরিবারে কোনো আর্থিক অনটন ছিল না। পড়েছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই আমার মতো ছেলে কেন ছাগল পালন করবে, এটাই ছিল মানুষের আপত্তির কারণ। কিন্তু মানুষের সেসব আপত্তি আমি গায়ে মাখিনি। নিজের মনের কথাই শুনেছি।’
এভাবে নিজের উদ্যোগের শুরুর কথা বলছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্বে স্নাতকোত্তর পড়া শিক্ষার্থী শুভ রায়হান (২৪)। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের বাড়ির ছাদে ছাগল পালন করে এলাকায় বেশ পরিচিতি পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জের এই তরুণ। ছাগল পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ায় এখন বাড়ির ছাদে বড় পরিসরে গবাদিপশুর খামার করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
শুভ রায়হানের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপসীতে। মা রওশন আরাসহ পাঁচ ভাইবোনের সঙ্গে রূপসীতেই বেড়ে উঠেছেন শুভ। গত বুধবার বাড়ির ছাদে রায়হানের খামারে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। টিনের চালা দেওয়া একতলা আধা পাকা বাড়ি রায়হানদের। সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস। পাশেই নির্মাণাধীন দোতলা বাড়ি।
নির্মাণাধীন সেই বাড়ির সামনেই দেখা রায়হানের সঙ্গে। দেখা হতেই একগাল হেসে বলেন, ‘ছাগলগুলো হাঁটতে বের হয়েছে। এখন ওদের খুঁজছি।’
এরপর রায়হান তাঁর খামার দেখাতে নিয়ে গেলেন বাড়ির ছাদে। ছাদে গিয়ে রীতিমতো অবাক। ছোট-বড় মিলিয়ে ২০ থেকে ৩০টি ছাগল ছাদে। কোনোটি শুয়ে আছে, কোনোটি খাবার খাচ্ছে। কিছু লতাপাতা হাতে রায়হান ছাদে উঠতেই কালো, সাদা, বাদামি রঙের ছাগলগুলো ঘিরে ধরল তাঁকে। খাবার দেওয়ার ফাঁকে কয়েকটি ছাগলের গলায় হাত বুলিয়ে আদরও করলেন। ততক্ষণে ছাদে ছেলের খামারে এসে হাজির মা রওশন আরা। এ কাজে মা আর ছোট ভাই আল রাজির কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন বলে জানান রায়হান।
এক থেকে আশি
ছেলেবেলা থেকেই বাড়িতে হাঁস-মুরগির লালন-পালন দেখে বড় হয়েছেন রায়হান। তখন ওই এলাকায়ও গরু-ছাগল লালন-পালন হতো। গত এক যুগে বেশ পরিবর্তন এসেছে এলাকাটিতে। গড়ে উঠেছে অনেক কলকারখানা। তাতে কৃষিজমি কমে গেছে। এ কারণে এখন আর কাউকে গরু-ছাগলের খামার করতে খুব একটা দেখা যায় না।
রায়হানের ফুফু শেফালি চৌধুরী তাঁদের সোনারগাঁয়ের বাড়িতে ৮০টির বেশি ছাগল পালন করতেন। তাই সময় পেলেই ফুফুর বাড়িতে ছুটে যেতেন রায়হান। সারা দিন খামারে সময় কাটত। তখন থেকে ফুফুর কাছে ছাগল পালন বিষয়ে হাতে-কলমে শেখা। এরই মধ্যে ২০১৮ সালে ছাগলের প্রতি আগ্রহ দেখে শেফালি চৌধুরী ভাইয়ের ছেলেকে ছোট্ট বাচ্চাসহ একটি যমুনা পারি জাতের ছাগল উপহার দেন। সে থেকেই রায়হানের ছাগল পালন শুরু। সেই ১টি ছাগল থেকে গত ৪ বছরে অন্তত ৮০টি ছাগল জন্ম নিয়েছে রায়হানের খামারে। রায়হান সেসব ছাগল লালন-পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এলাকাজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন। ছাগল বিক্রির টাকায় ঘুরেছেন একাধিক দেশ।
শুরুতে ধাক্কা
শহুরে জীবনে অভ্যস্ত এক তরুণের পক্ষে বাড়ির ছাদে ছাগল পালন করে সফলতা পাওয়ার কাজটি করা খুব সহজ ছিল না। একদিকে খাবারের সংকট, অন্যদিকে আশপাশের মানুষের কটু কথা। এ ছাড়া ছিল দক্ষতার অভাব।
শুভ রায়হান বলেন, ‘আমাদের পুরো এলাকায় কলকারখানা। কোনো চারণভূমি নেই। ছাগল পালনে চারণভূমি খুবই প্রয়োজনীয়। সেটি বুঝেছি উপকার পাওয়া প্রথম ছাগলটি মারা যাওয়ার পর। ঘাসের অভাবে না বুঝে নানা কিছু খাইয়েছিলাম মা ছাগলটিকে। তাতে এক সপ্তাহের মধ্যে ছাগলটি মারা যায়। তত দিন অবশ্য মা ছাগলটি দুটি বাচ্চা দেয়। সেখান থেকে পরে ৮০টি ছাগল জন্ম নিয়েছে।’
রায়হান আরও জানান, প্রথম দেড় বছরে রোগাক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু ছাগল মারা যায়। ওই সময় ছাগলের রোগবালাই বিষয়ে জানাবোঝার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। এরপর কোভিডের সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার সুযোগে ছাগল পালনে দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। তবে তখন নতুন আরেক সমস্যা তৈরি হয়। ছাগলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেগুলো আশপাশের মানুষের বাড়িঘরে চলে যেতে শুরু করে। তখন আশপাশের মানুষের কাছ থেকে অভিযোগ আসতে থাকে। আবার সড়ক দুর্ঘটনায় বেশ কিছু ছাগল মারা যায়। তখন বাধ্য হয়ে বাড়ির ছাদে ছাগল পালন শুরু করি।
ছাগলের জন্য লতাপাতা বা ঘাস কোথায় পান, জানতে চাইলে রায়হান বলেন, ‘আশপাশের কলকারখানাগুলোর খালি জায়গায় ঘাস জন্মায়। সেগুলো পরিষ্কার করতে গেলে কারখানা কর্তৃপক্ষকে আলাদা খরচ করতে হয়। সেটা না করে তারা আমাকে খবর দেয়, আমি বিনা পয়সায় সেগুলো কেটে নিয়ে আসি। এ ছাড়া আশপাশ এলাকার কোনো বাড়িতে গাছের ডালপালা কাটা হলে তারা আমাকে খবর দেয়। আমি গিয়ে নিয়ে আসি।’
শুরুতে নানা রকম কটু কথা বললেও এখন আশপাশের মানুষেরা রায়হানের কাজে সহযোগিতা করছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম রায়হানের ছেলেবেলার বন্ধু মাহমুদুল হাসান। রায়হানের খামারের ছাগল অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা করেন মাহমুদুল।
প্রস্তুতি বড় খামারের
ছাগল পালনে সফল হওয়ার পর এখন আরও বড় স্বপ্ন দেখছেন রায়হান। স্নাতকোত্তর শেষে নিজের ছোট্ট খামারটিকে আরও বড় করতে চান। সে জন্য এরই মধ্যে প্রস্তুতিও শুরু করেছেন। অনেকেই এখন তাঁর খামারে বিনিয়োগে আগ্রহী। তাই পড়ালেখা শেষ করে বড় পরিসরে একটি কৃষি খামার করার স্বপ্ন রায়হানের। সেখানেই কর্মসংস্থান তৈরি করতে চান।
ছেলের এমন কাণ্ড ভালোই লাগে বলে জানালেন মা রওশন আরা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ছেলে যা করে শান্তি পায়, আমি তাতেই খুশি। এটাতে ওর আগ্রহ আছে। তা না হলে একটা ছাগল থেকে মাত্র চার বছরে এত দূর আসতে পারত না। আশপাশের মানুষ অনেকেই অনেক কিছু বলে। কিন্তু মা হিসেবে আমি ছেলের স্বপ্নপূরণের সঙ্গী হতে চাই।’
সূত্র : প্রথম আলো