দুই বছর যেতে না-যেতেই হঠাৎ ওই তিন বন্ধুর হাঁসগুলো ‘ডাক প্লেগ’ রোগে মারা যায়। তারা তিনজনই হতাশ হয়ে হাঁস পালন করা ছেড়ে দেয়। আমি দুই বছরে তাদের হাঁস পালন ও ডিম বিক্রির লাভ দেখে বাড়িতে গিয়ে বাবা আবদুর রহমানের কাছে হাঁস এনে দেওয়ার জন্য কাঁদতে থাকি। কয়েক দিন কান্নাকাটি করার পর বাবা ঘরে রাখা ৮৬ মণ ধান ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। আমাকে বলেন, পড়ালেখা যখন করবি না, তখন এই নে, তোকে ৩০ হাজার টাকা দিলাম, হাঁস এনে পালতে থাক। আমি ওই ৩০ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা নিয়ে এলাকার আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে সিলেটের বানিয়াচং উপজেলা থেকে ৩০০ হাঁস কিনে আনি। হাঁসগুলো বাড়িতে এনে জাল ও বাঁশের খঁুটা দিয়ে বেড়া বানিয়ে নদীর পাড়ে রাখি। হাতে থাকা বাকি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে খামার পরিচালনা করতে থাকি।
এক মাসের মাথায় ৩০০ হাঁসের মধ্যে ২৫০টা হাঁস ডিম পাড়া শুরু করল। প্রতিদিন খামারের খরচ করেও আমার হাতে থাকে ৪০০ টাকা। আমি এক বছর পর বাবার দেওয়া ৩০ হাজার টাকা বাবাকে দিয়ে দিলাম। দুই বছরের মাথায় খামারের লাভের টাকা দিয়ে আরও এক হাজার হাঁস কিনে আনলাম। সারা এলাকায় আমার খামারের নাম ছড়িয়ে পড়ল। এখন আমার খামারে পাঁচ হাজার ছোট-বড় হাঁস আছে। হাঁসের খাবারের খরচ বাদ দিয়েও আমার দৈনিক চার হাজার টাকা লাভ হচ্ছে।
আমার হাঁসের খামার দেখে নিকলীর অনেক লোক হাঁসের খামার করেছে। তাদের সবারই ভাগ্যে পরিবর্তন হয়েছে। আগে যারা বেকার যুবক ছিল, তারা এখন অনেকেই হাঁসের খামারি। আমার খামারে দুই জাতের হাঁস আছে। একটার নাম নাগিনী; এই জাতের হাঁস সারা দিন নদীতে ঘুরে ঘুরে খাবার খায়। ডিম দেয় বেশি। অন্য জাতের নাম হলো খাগি; এরা নদীতে কুড়িয়ে খায় না। আমরা খামারিরা এগুলোকে ধান, গম ও শামুক কিনে খাওয়াই। আবার এ জাতের হাঁস ডিম দেয় কম। এ কারণে আমরা সবাই নাগিনী হাঁস পালন করি বেশি। নাগিনী হাঁস তিন বছর একটানা ডিম দেয়। ডিমের সংখ্যা কমে এলে সেগুলো বিক্রি করে নতুন নাগিনী হাঁস কিনে আনি। কারণ, আমরা তো বেশি ডিমের আশায় হাঁস পালন করি। যে খামারে যত বেশি নাগিনী হাঁস আছে, সে খামারের মালিক ডিম পান তত বেশি।
আমার জানামতে, নিকলীতে এখন ৫০০-এর বেশি হাঁসের খামার আছে। সব খামার মিলিয়ে প্রতিদিন তিন লাখ ডিম হয়। আমরা প্রতিটি ডিম সাড়ে আট টাকা করে পাইকারি বেচি। আমাদের কাছ থেকে ডিমগুলো যায় মূলত নিকলীর ডিমের পাইকারদের কাছে। আমাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে ঢাকার কারওয়ান বাজার, ঠাটারী বাজার, চিটাগাং রোডসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে তারাও লাভবান হচ্ছে। ডিম বিক্রি নিয়ে আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। কার্তিক থেকে জ্যৈষ্ঠ, এই আট মাস আমরা এলাকার খামারিরা হাঁসগুলো থেকে ডিম পেয়ে থাকি।
কিন্তু আমাদের কিছু সমস্যা আছে। আমাদের হাঁসের খামারে যখন ডাগ প্লেগ ও রানীক্ষেত রোগ দেখা দেয়, তখন নিকলীর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমরা যথেষ্ট সহযোগিতা পাই না। তাঁদের কাছে টিকা থাকে। টিকার সরকারি দাম ৩০ টাকা, কিন্তু নির্ধারিত দামে টিকা পাওয়া যায় না। দাম দিতে হয় ৫০ টাকা। বেশি টাকা না দিলে বলা হয় পশু হাসপাতালে কোনো টিকা নেই। আপনারা বাইরে থেকে কিনে আনেন। এমনকি, তাঁরা খামারে আসতেও চান না। পশু ডাক্তারদের খামারে আনতে হলে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। টাকা না দিলে আসেন না। এ সময় টিকা না পেলে এবং ডাক্তার আমাদের খামারে না এলে খামারের বড় ধরনের ক্ষতি হয়। এমনকি খামারের সব হাঁস মরে যায়। এ সময় যদি পশু ডাক্তাররা টিকা বা পরামর্শ দিতেন, তাহলে আমরা খামারিরা উপকার ও বড় ধরনের ক্ষতির থেকে রক্ষা পেতাম। তাই তাঁদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, তাঁরা যেন আমাদের পর্যাপ্ত টিকা সরবরাহ করেন, পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন।
একদিন সকালবেলা আমি হাঁসের খামারে ডিম তোলার সময় প্রথম আলোর নিকলী প্রতিনিধি আমার খামারে এসে উপস্থিত। তিনি বললেন, আমার হাঁসের খামার নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখবেন। এই বলে খামারের ডিম তোলার ও নদীর পাড়ে হাঁসগুলোকে খাবার দেওয়ার ছবি তুললেন। ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বরে প্রথম আলোতে ‘নদীতে খেয়ে খামারে ডিম’ শিরোনামে একটা প্রতিবেদন ছাপা হলো। সেদিন আমার খামার ও আমাকে দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক শ লোক আসে আমাদের বাড়িতে। তারপর থেকে চট্টগ্রাম, খুলনা, ফরিদপুর, সুন্দরবন, কুমিল্লা, গোপালগঞ্জ, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, ঝিনাইদহ ও বরিশাল থেকে অনেকেই ফোন করে। তারা আমার কাছে পরামর্শ চায়। কীভাবে তারা হাঁস পালন করতে পারবে, জানতে চায়। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু পারি তাদের পরামর্শ দিয়েছি। কয়েকজন খামার করার জন্য আমার খামার থেকে হাঁস কিনে নিয়ে যায়।
সবকিছুর জন্য আমি প্রথম আলোর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমাকে তো আগে কেউই তেমন চিনত না। আমাকে বা আমার হাঁসের খামার দেখতে আসত না। প্রথম আলোর জন্যই আজ আমাকে বিভিন্ন জেলার লোক মোবাইলে ফোন করে হাঁসের কোনো রোগ হলে পরামর্শ নেয়। আমি যতটুকু জানি তাদের মোবাইল ফোনেই পরামর্শ দিই।
একসময় আমি এবং আমাদের সংসারের সবাই গরিব ছিলাম। আমি মানুষের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেছি। মানুষের খেতে দিনমজুরের কাজ করেছি। আমি এখন ১২ একর বোরো জমিসহ ২৫ লাখ টাকার মালিক। আগে ভাঙা ঘরে থাকতাম, এখন আমার বড় একটা পাকা ভিটের টিনশেড ঘর হয়েছে। নিজে তো এখন আর লেখাপড়া করতে পারছি না, তাই দুই মেয়েকে আমি লেখাপড়া করাচ্ছি। আমার বাবা মারা গেছেন ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি। বাবা বেঁচে থাকলে আমার এ অবস্থা দেখে খুব খুশি হতেন।
হাঁসের খামার একটা লাভজনক ব্যবসা। আমি বিশ্বাস করি, ঠিকমতো হাঁসের টিকা ও খাবার দিতে পারলে হাঁসের খামার করে আমার মতো সবাই স্বাবলম্বী হতে পারবে। তার ফলে দেশে বেকার যুবকের সংখ্যাও কমে আসবে। এখন হাঁসই আমার সব। হাঁসের সঙ্গেই আমার ওঠাবসা। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম—সবই হাঁসের সঙ্গে। (অনুলিখন)
মো. জিল্লু মিয়া, হাঁসের খামারি, নিকলী, কিশোরগঞ্জ
সূত্র – প্রথম আলো